১| ৺শ্রীনৃপেন্দ্রনাথগুপ্ত(সংশোধনকারী)
২| ৺শ্রীজীতেন্দ্র নাথবসাক(সংশোধনকারী)
৩| ৺শ্রীঅতুলচন্দ্রগুপ্ত ( শিক্ষক,কালিয়াচকহাইস্কুল) (সংশোধনকারী)
৪| শ্রীনিমাইচন্দ্রপাল (সংশোধনকারী)
সাধু বঙ্কট বাবার জীবন বৃত্তান্ত তার, জীবদ্দশায় যারা তাকেঁ চাক্ষুষ দর্শন করেছেন তাদের নিজ অভিজ্ঞতা থেকে লেখক লিপিবদ্ধ করেছেন এখানে তার বিবরণ প্রকাশ করা হলো।
গ্রন্হারম্ভের পূর্বে শ্রুতি সম্পন্ন : উক্তি--
যুগলতলা গ্রাম নিবাসী সাধক বঙ্কট বাবার কৃপায় ধন্য পরিবারের শ্রদ্ধেয় কানাইলালের উক্তি তৎকালে তার বয়স তিরাশি বছর আমি তার নিকট উপস্থিত হয়েছি কথা প্রসঙ্গে আলোচনা হলে আমি তাকে অনুরোধ জানায় আপনি বাবার ইতিহাস জ্ঞাত অতএব আমাকে জ্ঞানতঃ আলোচনা সভায় বলুন কানাই ঘোষ আনন্দিত হয়ে বলতে আরম্ভ করলেন বাবার তিরোধান এর সময় আমার বয়স ২২ বছর ১০ বছর বয়স হতে মাঝেমধ্যে বাবার নিকট যাওয়া আসা করতাম বহু ভক্তের সমাগম হত বাবা আলোচনা করতেন তা আমি মনোযোগ দিয়ে শুনতাম আবার প্রশ্ন করতাম কোনদিন দেখতাম বাবার নিত্যকর্ম সমাধান হয়ে বসে আছেন ভক্তগণ প্রসাদ চাইলে বাবা বাতাসা ও দধিদিতেন সকলে আনন্দের সহিত প্রসাদ নিতাম কিন্তু লক্ষ্য করতাম দিতে পোকা। তখন বলতাম বাবা পিল্লু। তখন রাগতস্বরে বলতেন শালা? কাহাঁ ? পিল্লু? খা লে! অনেকে ফেলে দিতেন, আবার কেউ কেউ ভক্ষণ করতেন আমি নিজেও ভক্ষণ করেছি যেন অমৃত পান করলাম এমন আস্বাদিত বস্তু জগতে দুর্লভ। হয়তো কেউ প্রশ্ন করল বাবা আপকা ওমর কিতনা বাবা মুচকি হেসে সালা মাইনে রাম চন্দ্রার জী কা সাদি দেখা থা। বাবাকে দেখে অতি বৃদ্ধ মনে হতো, যেহেতু পাকা জোটা যুক্ত পৃষ্ঠ অব্দি দোদুল্যমান কেশ, গাত্র লোমাবলিও পাকা। দীর্ঘকায় আজাদুলম্বিত ভূজ গেরুয়া বসন ধারী করে কমুন্ডল কোপীন বহির্ব্বাস আচ্ছাদিত। কিন্তু বয়স্ক হলেও স্থূল দেহ অতি বলিষ্ঠ দেখাতো। আমিও প্রশ্ন করেছি, বাবা আপকা মাকান কাহাঁ? পিতাজি কা নাম অর জন্মভূমি পরিচয় কি আর কিস লিয়ে দেহ কো ইতনা কুচ্ছ সাধন মে ফেক দিয়া কৃপা সে বলিয়ে বারকার হাম লোকা দিলখুশ হো যায়ে?
বাবা শুনে বিমর্ষ চিত্তে উত্তর দিলেন হাম ইউ পি কে রেহনে বালা হামারা উমার যব পাঁচ সাল হো গেয়া তো সাধু সঙ্গমে চলা গায়া। কুছ দিন সাধু লোগো কে ডেরা মে হামারা দিল কা উদাস ভাব আ-গায়া। ঘুম নেমে কই তাকলিফ কা আমাল হি নেহি। পাহাড় কা গুহা কে অন্দর জঙ্গল ঝোপ-ঝাড় বাদলা খানাপিনা সাভি কুছ ভগবানকে আসামে ডাল দিয়া। জব ২৫ বারষ উমার হুয়া, তব মেনে সোচা কি পিতাজী মাইজিও দেখুঙ্গা।
সাধু লোগো কো বোলা হামারা দিল চাহতা হ্যায় কি ঘর জাউঙ্গা শুনকর গুরুজি নে বোলা যাও ঘর সে ঘুম কো আ জানা ধারামকে শ্রেষ্ঠ পন্থা যা দুনিয়াকা কল্যাণ মে, ইস জীবন কো বিতা দেনা। আত্মা কো মার্চ মাসে মিল নাহি তো নিষ্কাম আরাধনা হোতি হ্যায়। আপনে লিয়ে মাঙ্গা তো দুখ কে শামীম আর সাবিকে লিয়ে ভগবান সে শুভকামনা সিদ্ধিকা লক্ষ্মণ হ্যায়। ইয়ে বাত শুনতে হয়ে প্রণাম করার আগে পিতাজি আউর মাইজিনে প্রণাম কিয়া দেখ কর হামারা ভি আনন্দ হুয়া। পিতাজী আউর মাঈ সাভিকে আনন্দ ভরপুর। পিতাজী নেব না তুম আভি জিন্দা হে। ইয়ে শুনকর হামারা অন্তর কাপঁ গায়। পিতাজী ইয়ে বাত বোলনে কা কারন মুঝে বাতাইয়ে। পিতাজী- দেখ তু জাব জানাম লিয়া তবে এক জ্যোতিষ আয়া। তেরা বদন দেখা আউর বহত খুস হুয়া। ইস লাড়কে কা বহুত শুভ চিহ্নারী দেখ রাহা হুঁ, লেকিন এক হি আফসোস কি বাত, বারা বরষ উমার হোনে সে ইয়ে দুনিয়া সে চালা জায়গা। পিতাজী হতাশ হো করে বোলা। জ্যোতিষী বাবা এ রাজ দুলারে হামরা এক হি আওলাদ, ইসকো বাচানে কি কৈ উপায় হ্যায় কি নেহি? জ্যোতিষী নে ভোলা উপায় এক হ্যায়, ঈশ্বর কা কৃপা। ইস্ লাড়কে নে পাঁচ বর্ষ সে সাধু সঙ্গমে জীবন বিতায়ে সাকে তো বহুত দীর্ঘায়ু হোগা। হামনে এবাত শুনকার তেরে লিয়ে বহুত দেব-দেবী নে মানাত কিয়া, বহু সাধু সন্তনে দান দে কর আশীর্বাদ লিয়া, যিস্ কামনা কি ফুর্তি মে তু বাঁচা হ্যায়। আজ সে তেরা নাম বাদাল গ্যায়া। তু বান কাট্ কর্ বাচাঁ, ইসলিয়ে তেরা নাম "বঙ্কট" রাখ দিয়া। সুনকর্ দিল কো হাম্ সুষ্ট কিয়া আউটডোর সে বোলা, যো সাধু সঙ্গমে রাহা কর মরণ্ কো জয় কিয়া,হাম্ আজ সে সাধু হি হো গ্যায়া। পিতাজী, ক্ষন্ ভঙ্গুর জীবন কা ক্ষণিক সুখ কে লিয়ে, বন্ধন মে নাহি রাহাকর মানব কল্যাণ কা ব্রত লিয়া, আশীর্বাদ যাঁচনা করতা হুঁ পিতা আউর মাই জি নে কাতর হো কার আশীর্বাদ দিয়া। কুছ দিন বাদ গুরুজী নে বোলা, বেটা অর জোর কদম সে "রাম"জী কা ধ্যান মে লাগ যা।
এভাবে ভক্তরা বাবার সাথে আলোচনা করতেন। একদিন গিয়ে দেখি, একজন ভক্ত প্রশ্ন করলেন- বাবা আপ্ তো ইউপি কে আদমি, উধার বহুৎ তীর্থ হ্যায় যো হাম্ লোগো কা বাসনা হোতা হ্যায়? আপ ইতনা আনন্দ ছোড়কর্ ইধার আঁধেরি মে কিস্ লিয়ে আ রাহে? বাবা মানব নে সরগ জানেকা অভিলাষ কারতা হে অর ভগবান নে ধরতি পর্ আতে হ্যায়। মেরা ভি ঐ সা হি অভিলাষ, পড়ে হুঁয় অভিলাষী ও নে দেখ্ কর ম্যায়ঁ ভি ধন্য হোউঙ্গে। বলা মাত্রই সঙ্গে সঙ্গে ভক্তগণ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে জয় বঙ্কট বাবা বলে ধ্বনি দিলেন। কিয়ৎক্ষণ নীরবে থেকে আবার বললেন, দেখা যায় জ্ঞান মার্গে যাদের গতি তারা কথা বলে কম্ যেমন ভরা কলস বাজলেও খুব একটা উচ্চৈস্বরে না বেজে একটা গাম্ভীর্যপূর্ণ শব্দ আসে। তদ্রুপ বঙ্কট বাবার কথা বার্তায় হুবহু প্রমাণ লক্ষিত হত। হামনে বহুৎ বরষ বিত্ গ্যায়ে ঘুমতে ঘুমতে আতা হ্যায়। কুচ দিন কাশি ধাম মে থা, মেরা কুটিয়া মে একরাত মহাপ্রভু নে বিশ্রাম লিয়া থা। উধার সে লট আয়া কালিয়াচক থানা কা নিমতল্লা শ্মশান ঘাট মে। উসকে বাদ আকর পাহুঁচা থানা কা লাগমাগ রালিয়াডাঙ্গা মে। অন্তিম দিল মে শোচা কি অউর ভি আগানে হোগা! চলনা মেরা কোই নাহি ঠাহার তে যিতনা দূর যা সাকে........
অতঃপর নিরব। বাবা আবার কিছুক্ষণ পর বলতে আরম্ভ করলেন- আভি তো সিলামপুর গাঙঁ মে পহুচঁ গ্যায় আউর ভক্তকে প্রেম সে এহাঁ ঠাহের গ্যায়ে। অন্তিম দিন তাক্ নাহি যাউঙ্গা এ গাঁঙসে।
অতঃপর বাবার অবস্থানকালে যা যা আচরণ দর্শন করেছি সব কিছুই শুনলাম। সর্বশেষ আমি একটি আশ্চর্য বিষয় দেখেছি। যার প্রেমে মুগ্ধ হয়ে বাবা যে অঙ্গনে অবস্থান করলেন সে স্থান শেষ জীবনে ত্যাগ করে সিলামপুর হট প্রাঙ্গণে রাখালবাবুর জায়গাতে কুটির বেঁধে থাকলেন কেন?( উক্ত জায়গাতে পরবর্তীকালে কর্মকার বাস করেছিল) উক্ত স্থানে অল্প দিন থাকার পর বাবার দেহ রক্ষা করেছেন। এ সম্বন্ধে বহু অনুসন্ধানে জানলাম। ভক্ত স্থানে থাকা কালিন "টাকা চুরি" হয় বাবা জানতে পেরে, হামারা রূপাইয়া কো লিহিস? কিন্তু উক্ত বাড়ির লোক কেহ স্বীকার না করায় বাবা, মনের দুঃখে হামারা রূপেয়া চোরি করভি, সব কৈ নাকাচ কর দিয়া? ভকত্ লোগ্ নে দেতা হ্যায়। হাম গোপালজী কা ভোগ মে লাগাতে হ্যায়। তাব্ কেউঁ এই সা কাম্ কিয়া?
নাহি রাহুঙ্গা হরিলাল কা ভিটা মে? (বিচার্য্য বিষয়) এর পরবর্তী ইতিহাস আর আমার উক্ত ভক্তের নিকট শুনা হয়নি। কারন আমার বাড়ি হতে যুগলতলা গ্ৰাম ৪ মাইল দূরবর্তী।
আমি উক্ত ঘোষ পরিবারে এক মাস লেখার কাজে যুক্ত ছিলাম। এই অবসরে বৃদ্ধ কানাই ঘোষ আসতো আমার অনুরোধে বঙ্কট বাবার ইতিহাস শোনাতেন। আমি পরবর্তী ইতিহাস শুনেছি ছবি (পাগলি) সাহা নামক ভক্তিমতী মহিলার নিকট, নিজে আগ্রহী হয়ে বাবার গল্প করতেন।
পাগলীর উক্তি আমার জ্ঞান হওয়ার পর বাবাকে দেখেছি সিলামপুর হাট প্রাঙ্গণে। আর ওইখানেই মরেছিলেন। আমি বাবার নিকট গেলে বাবা আদর করে প্রসাদ দিতে দই, ক্ষীর, বাতাসা। কিন্তু দই এর মধ্যে পোকা কিলবিল করত। বোকা বলে চেঁচিয়ে খেলতে যেতাম কিন্তু বাবা ফেলতে দিত না। আদর করে বলতো পাগলী মাৎ ফেকিয়ে, খা লে। তখন খেয়ে নিতাম, অপূর্ব স্বাদ; মনে হতো আরো পেলে খাব। সুলতান পাইকার (পিপল তলা) বৃদ্ধ ব্যক্তি ভেবে তার নিকট গিয়ে তাকে অনুরোধ করলাম বঙ্কট বাবার ইতিহাস শুনাতে। উনি আশি বৎসর বয়স্ক লোক অচলাবস্থা, তবুও আমার অনুরোধে বললেন আমার অসুস্থতার কারণে জানা সত্ত্বেও বিশেষ বকতে পারবো না, তবে দু'চারটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমার বয়স ১১ বছর, গরু চড়ায় কোন কোন দিন সিলামপুর দোকান করতে যেতাম, তখন দেখতাম বঙ্কট বাবার নিকট বহু ভক্ত আছে আলোচনা হচ্ছে। আমি ভিন্ জাত এজন্য আসরে যেতে পারতাম না- তফাৎ হতে শুনতাম। এমন সময় দেখি জগন্নাথ ঘোষ এর মা দুধ নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এসে পৌছালো। বাবাকে বললো বাবা আমি দুধ নিয়ে আসছি, রাস্তায় আমাকে কে যেন মারছে, দেখো আমার গায়ের দাগ। আমি তো লোকজন দেখলাম না বাবা হাসতে হাসতে বললেন, মায় মাৎ রো,দুধ লানে মে বহুত দের্ হোগায়ে- ইস্ লিয়ে গোপাল জি নে ক্রোধ কিয়া, ধুনি সে ছাই লাগা দে, তখলিপ্দূরহোগা। সে চলে যাওয়ার পর ভক্তগণ বাবার নিকট হতে সরে গিয়ে বলাবলি করছিল, বাবা একটু আগে নাড়ুগোপাল ভগবানকে বেত্রাঘাত করে বললেন আজ দুধ কিউঁ নাহি আতা হে? হাম কেয়া খাউঙ্গা? আমি উক্ত বার্তা শুনলাম। একদিন সিলাম পুর হাটে গিয়ে দেখি বাবা কমন্ডুল হাতে ভিক্ষা করছেন, যার যা ইচ্ছা পয়সা কড়ি, চাল-ডাল, তরকারি এমনকি মিষ্টি মিষ্টান্ন ওই কমন্ডুলের মধ্যেই দিচ্ছে। কেউবা বাবার কেরামতি (মাহাত্ম্য) পরীক্ষা করতে, কমন্ডুল মুখাপেক্ষা বড় ফল দিচ্ছে, কি বাবার শক্তি অবাধে কমন্ডুলে ঢুকে যাচ্ছে। একদিন দোকান যেতে যেতে দেখি বহু লোক জমায়েত হয়ে, আছে আর ওই ভিড়ের মধ্যে ইংরেজ সাহেবের জিপ্ গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাবা মাঝ রাস্তায় বসে পায়খানা করছে। খুব জোরে জোরে ভর্ ভর্ শব্দ হচ্ছে মনে হয় যেন অনেকটা পায়খানা হলো। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকায় সাহেব রেগে, সাধু লোগ বহুৎ জোচ্চোর হোতা হ্যায়। পায়রাঁ মে হাগতা হ্যায়,আউর কিতনা দের্ হোগা? আভি তাক্ বৈঠা হ্যায়? পায়রাঁ ছোড়িয়ে, নাহি তো গাড়ি চালা দেঙ্গে? কোন ভ্রুক্ষেপ নাই বাবার। সাহেব গাড়িতে চেপে স্টার্ট দিলেন কিন্তু ইঞ্জিন অচল। স্তম্বিত সাহেব নিরুপায় হয়ে কর'জোরে জানালেন বাবা হাম্ সরকার কে লোগ, দেশ কা কাম কর্ নে বালা। অন্যায় কো দমন কর, ন্যায় কো রক্ষা করনা- এহি তো ঈশ্বর কা কাম্। আপ সাধু হো কর যো ঈশ্বর কার মে লাগে হ্যায়! উন্ কাহি সেবামে হামকো ভি জানা হ্যায়, বহুত দের্ হোগেয়া- মুঝে মাফ্ কর প্রসন্ন হোয়য়ে।
বঙ্কট বাবা উত্তর দিলেন- যা সাহাব আভ তেরা গেয়ান আয়া হ্যায়। কবি কৈ সাধু কো বুড়া মাৎ বোলনা। আমি অনেক কিছুই জানতাম কিন্তু আর বলতে পারছি না। বাবা শেষ জীবনে সিলাম পুর হাট প্রাঙ্গণে রাখালবাবুর জায়গাতে দেহ রেখেছেন বাবা যেদিন মারা যান, সেদিন হিন্দু-মুসলমানের ভীর, সবাইকে বাবা ভালোবাসতো এই জন্যই সবাই জমায়েত হয়েছিল। আমিও দেখতে গেলাম বাবা মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। মেয়াদের জায়গাতে বাবার কবর খুঁদছে আর ওই সময়ে......পাঝরা এসে বলছে এখানে কিসের ভীড়? সকলে বলল বঙ্কট বাবার মৃত্যু হয়েছে। একথা শুনে মহালদার হুংকার দিয়ে বললো, আমি খেজুরিয়া ঘাটে নৌকা হতে নামলাম। বাবার নৌকাতে চাপছে। আমি বললাম বাবা আপ কাহা চল্ রাহা? বাবা- ম্যায়ঁ বৃন্দাবন যা রাহা হুঁ, কিসি কো মাৎ বোলনা, নাহি তো খাত্ রা হোগা!
সুলতান পাইকারের জানা সত্ত্বেও এর চেয়ে অধিক বলতে পারলেন না।
শ্রী রাখাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের উক্তি- বঙ্কট বাবার বৈশিষ্ট্য দেখেছি। এখানে অবস্থানকালে অন্ন রান্না করে খাই নাই- ফল মূল দধি ছানা ইত্যাদি তাঁর জীবন ধারণ উপযোগী ছিল, একমাত্র মাঝে মাঝে আমার বাড়ি এসে রাধা বিনোদের প্রসাদ সেবা নিত। একদিন সে বাতে বসে বলে উঠলো, নাহি আজ সেবা লেঙ্গে। তেরা ঘর ছুৎ হোগেয়া! আমরা বাড়ির সবাই হতভম্ব বাবা এমন কি দেখল? যা হোক চলে আসার কিছুক্ষণ পর চিঠি আসলো তাতে আত্মীয়বিয়োগ লিখিত। তখন বুঝলাম বাবা ভবিষ্যৎ বক্তা। এটাও অনুভূতি সম্পন্ন: যে দিন দেহ রক্ষা করলো, আমি চিন্তা করলাম আমার যায়গাতে যখন বাবার শর্বাঙ্গশায়িত অতএব ওখানেই সমাধি করা যাক্। আবার চিন্তা হলো, সেবা কে করবে? না- এ দেহ পাগলা শ্মশানে গঙ্গা সমাধি করে দেওয়া হোক। গ্রামস্থ লোকেরাও আমার কথায় সম্মত হলো। ইত্যাবসরেমিয়াঁরা এসে বললো, বাবাতোচলগায়া, ইসকা গতি ক্যায়াশোচতেহ্যায়? গ্রামস্থ লোকেরা বলল, চাচা সাহেব হাম্লোগশোচাহ্যায় কি নদীকে কিনার মে গাড়ঁদেয়্। মিয়াঁরা- নাহি ইনকা সমাধি হামলোগ্কাজামীন মে দিজিয়ে। কিসিকা দিল চাহে তো পূজা ভিকরসাকে! সাধু লোগ্তুমলোগকাপিয়ার হোতা হ্যায়, লেকিন এ সাধু বাবা হাম্লোগ্কা ঘার জাতাআউর বহুত পিয়ার সে বোলতা, ক্যা আকবর আলী মিয়াঁ, বাবার আলী মিয়াঁ হাম চলা আয়া। বাবা কিস্লিয়ে এইসা বোলনা? কইকি আপ কো কুছ বোলা হ্যায়? বলি হে ক্যায়া করনা না হ্যায়? বাবা- কুছ নাই এইসাহি চলা আয়া। তুমলোগকা প্রেম সে বাধাঁহ্যায়, ইসলিয়েদেখ্ নে কা মন কিয়া। এইসা প্রেমিক সাধুবাবাথা। অতএব মিয়াঁদের আগ্রহে আমরা ঈষৎ লজ্জিত হয়ে হাট প্রাঙ্গণেইসমাধিস্থ করেছি বাবাকে। এখন আমাদের কর্তব্য বৎসরান্তে তাঁর তিরোধান দিবসে (৯ই পৌষ) সম্মিলিতভাবে সেবা করা।
রাখাল বন্দ্যোপাধ্যায় এর নিকট এই পর্যন্তই শুনেছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ প্রামানিকের (সিলামপুর) উক্তি আমি মাঝে মাঝে বঙ্কট বাবার নিকট যেতাম্। ক্রমে ক্রমে ভক্ত সমাগম বাড়তেই থাকে একদিন দেখি হাতিতে চেপে চাঁচল এর রাজা এসে বাবাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সাধাসাধি করছেন। বাবা হাম বহুত আশা লেকর্আয়াহুঁ, কৃপা সে হামারাহাতিমের চড়কে চলিয়ে। আপকে লিয়ে হাম বাহুট সুযোগ কর্দেঙ্গে। কৈতাকলিফ্হোগায়া হি নাহি। বাবা- তুমনেহামকোলেজায়েসকোগে? কেয়াগনেশ বাবা! তুমহারা দিল কা বাত্ বাতলাও? হাতি নে মাথা নিচু করে না! এবারে বাবা ক্রোধান্বিত স্বরে বললেন শালা রাজ দিমাগ্দিখানে কো আয়াহ্যায়? হাম এঁহাসে নাহি যাউঙ্গা, এহিসিলামপুর গাঁও মে অন্তিম দিন তক্রেহেঙ্গে। দেখ রাহা হুঁ কি হামে মারনে কে বাদ হামকো মা গাঙ্গীলেযায়েগা, আউরকালিয়াচক শাহের বনেগা।এরাতউদ্দিনমিয়াঁর নিকট ও কিছু কিছু ইতিহাস পেয়েছি, বাবা দুধ খাওয়ার জন্য বিশ্বাসের বাড়ি যেতেন। তারঁ ভালোবাসা ছিল, পুত্রবৎ, আঙ্গিনার ভিতরে ঢুকে কড়াই ভর্তি দুধে কমন্ডুল ভর্তি করে চলে যেতেন। বাড়ির কর্তারা এসে এসব শুনে মেয়েদের বলতো তোমরা পরিষ্কারভাবেকড়াইমেজে দুধ জ্বাল দেবে, যেহেতু সাধুবাবা দুধ খাচ্ছেন অপরিষ্কার এর দরুন আমাদের পাপ্ হবে!
এভাবে বহু কিছু আলোচনা হতে থাকে, যথাসম্ভব শুনে সংগ্রহ করে পুস্তক আকারে লিপিবদ্ধ করলাম।
গোবর্জ্জনা নিবাসী বিশিষ্ট পরিবারের একজন বৃদ্ধ শ্রী অজ্ঞাত চন্দ্র রায় কালী মন্দিরে বসে আমার নিকটে বঙ্কট বাবার কাশীধামেঅবস্থানকালে মহাপ্রভুর একরাত্রি বিশ্রাম তারঁ (বঙ্কট বাবার) কুঠিরে- ইহা ভারতের সাধক গ্রন্থে দেখেছি।
এভাবে শ্রুতি সম্পন্ন উক্তি ও বাবার অপ্রকটে তাঁর মাহাত্ম্য, আমার চাক্ষুষ দর্শন, একত্রিত করে এই পুস্তকে লিপিবদ্ধ করা হলো।
সকলের প্রতি মোর করজোড়ে নিবেদন। ভুল-ভ্রান্তি নিজ গুনে করিবেন মার্জ্জন।।
সমাপ্ত-- ১৩৮৭ সাল
বিণীত--
ব্রহ্মচারী বৈদ্যনাথনাথ সাহা
সিলামপুর-
জ্ঞান ও কর্ম যোগী সাধক বঙ্কট বাবার জীবন কথা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জগতের দার্শনিক চিন্তাধারার গঙ্গা-যমুনার এক সঙ্গম ক্ষেত্র বলতে পারি। সেটা এই বিপুল পরিধির মধ্যে বাবা বঙ্কট বিহারীর স্বচ্ছন্দ বিচরণ আমাদের মধ্যে এক পরম বিস্ময় ও কৌতূহলজাগিয়ে তোলে। তিনি যে সমুদয় অলৌকিক ক্রিয়া পদ্ধতি পরিবেশন করেছেন সেগুলি জ্ঞান কর্ম সমুচ্চয়অর্থাৎ জ্ঞান ও কর্ম একই পুরুষের দ্বারা এক কালেই অনুষ্ঠেয় অথচ দীর্ঘদিন কাল ধরে সিলামপুরবাসিকেই কেবল নয় তাকেও অতিক্রম করে এ ক্ষুদ্র পরিমণ্ডলকে অতিক্রম করে, স্থান কাল পাত্র কে অতিক্রম করে, সমস্ত মানুষকে আত্ম উপলব্ধির প্রেরনা যোগাবে এবং মনুষ্যত্বেরজয়গান করে জীবাত্মার মুক্তির পথের নির্দেশ দিবে।
বাবা বঙ্কট বিহারীর জীবনকথা সুখ-দুঃখ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও জন্ম মৃত্যুর এক অপূর্ব সেতুবন্ধন রচনা করেছে। এই সর্বত্যাগীসন্ন্যাসীর জীবনের মূলমন্ত্র ও আচরণ বিধি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, জন্ম, জরা, মৃত্যু কণ্টকিত এই সংসার- অনিত্য ও মোহ নাগপাশের আলয়। আত্ন জ্ঞান ও আত্ন উপলব্ধির দ্বারাই এ সংসার প্রবাহ হতে ইহজীবনের মুক্তি এবং দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি সম্ভব। বিষয় বৈভব স্বচ্ছ জীবন পথের অন্তরায়মহাযোগী সাধক বঙ্কট বাবা সর্বত্যাগী হয়ে সিলামপুরে এক দীন দরিদ্র কুটির নির্মাণ করে সমস্ত মানুষকে প্রেমের বাণী দিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে ভ্রাতৃত্বের বাণীতে উদ্ধৃত করে এক মহানন্দময়ী লীলাক্ষেত্র রচনা করে গেছেন। যা যতদিন জাতি থাকবে, যতদিন আকাশে চন্দ্র সূর্য উদিত হবে, ততদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে সকলকে আকর্ষণ করবে। এখানে ধনী-নির্ধন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলে মিলে এক পরম স্বর্গীয় সুখ লাভ করে, জন্ম সার্থক করবে।
এই প্রসঙ্গে আজ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়সিলামপুরবাসীদের বাবা বঙ্কট বিহারীর প্রতি অনুরাগ ও তার প্রতি এক নিষ্ঠতার কথা। তাদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও কর্মতৎপরতায় এখানে গড়ে উঠেছে বাবার ভাব্ ঘন সমাধিক্ষেত্র যা সমস্ত মানুষকে যুগ যুগাধি ধরে জীবের মঙ্গলের কথা, প্রেমের কথা শোনাতে থাকবে আর জীবকে আত্ম উপলব্ধির শক্তি লাভের প্রেরনা দেবে।
বিভিন্ন জনশ্রুতি বাবার জীবনের বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করে তার অলৌকিক জীবনকথা আজ চিরসত্য ও জীবজগৎ হতে প্রাণের একমাত্র লক্ষ্য রূপে পরিগণিতহয়েছে। আজ এই সমাধিক্ষেত্রে প্রতি বছর ৮ই পৌষ হতে মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় এবং দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন বৈষ্ণব মহাজনগণ লীলা কীর্তন পরিবেশন করে এই ক্ষুদ্র গ্রাম ও পরিমণ্ডলকে স্বর্গীয় সুষমার পরিমন্ডলে পরিণত করে প্রয়াগাধি তীর্থের অমৃতের স্বাদ প্রদান করে জীবকে আধ্যাত্বিক-সুখলাভে উদ্বুদ্ধ করে আসছে।
এই প্রসঙ্গে বিশেষ করে মনে পড়ছে শিষ্য শ্রী বৈদ্যনাথ সাহাকে, যার সমগ্র জীবন বাবার জীবন কথায় "পঞ্চমুখ"। "সাধক বঙ্কট বাবা" এই মূল গ্রন্থ টি পরিবেশন করেছেন শ্রী বৈদ্যনাথ সাহা মহাশয়।
পরিশেষে শ্রী জীতেন্দ্র নাথ বসাক মহাশয় (কীর্তনীয়া কুচবিহার) এই গ্রন্থ প্রণয়নেঅকুন্ঠ সহযোগিতা করায় আমাদের নিকট চিরকাল শ্রদ্ধাভাজন হয়ে থাকবেন।
সর্বশেষে আমি অতি যত্ন সহকারে এই অমূল্য গ্রন্থটি সংশোধন, পরিবর্ত্তন ও পরিবর্দ্ধন এবং সংযোজন করার চেষ্টা করেছি, তথাপি যদি জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে কোন ত্রুটি পরিবেশিত হয়ে থাকে, তাই সুধী মন্ডলীর নিকট এবং ভক্তবৃন্দের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
ইতি-
শ্রী নৃপেন্দ্রনারায়ণ গুপ্ত
শিক্ষক, কালিয়াচক হাইস্কুল
শিব ভূমি এই ভারতের পূর্বে আদিনাথ, পশ্চিমে কোটেশ্বর, দক্ষিণে রামেশ্বর ও উত্তরে কেদারনাথ অবস্থিত। সুন্দর বিশ্বের মঙ্গলের জন্য এই ভারত ভূমিতে যুগে যুগে ভগবান নানা রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। এসেছেন সংখ্যাতীত বিশ্ব হীতকামি যোগসিদ্ধ মহাজন গন। ভারতের প্রতিটি ধূলিকণা এই সব অবতার ও মহাপুরুষদের পদধূলিতে পরম পবিত্র রজ:।
তাই ভারতকে বলা হয় দেবভূমি। এই যোগসিদ্ধ মহাপুরুষদের কৃপায় বহু পাপীতাপী উদ্ধার পেয়েছে। প্রচার মাহাত্ম্যে অনেকে সর্বজন বিদিত।
আবার অনেকে আছে যারা প্রচার বিমুখ বা ভষ্মাচ্ছাধিত বহ্নিবৎ। খুব অন্তরঙ্গ ও স্থানীয় কিছু ভক্ত মন্ডলী ছাড়া যাদের প্রচার ছিল না- বললেই হয় এদের অন্যতম সিদ্ধ যোগী, ভারতের গুপ্ত সাধক "জয় বঙ্কট বাবা"। তাঁর এক বিস্ময়কর অলৌকিক কাহিনী ক্ষুদ্রজ্ঞানে বিচার করা চলে না।
ভারতে তখন ইংরেজ শাসন, এপারে খেজুরিয়া ঘাট, ওপারে ফারাক্কা- তারই মধ্যে খরস্রোতা ভাগীরতী গঙ্গা প্রবাহমান। আজকের ফারাক্কা ও খেজুরিয়া ঘাটের সঙ্গে সেদিনের ফারাক্কা ও খেজুরিয়া ঘাটের রূপ আকাশ পাতাল তফাৎ। সেদিন স্রোতস্বিনী গঙ্গার বুক্ষে সুইচগেট সহ কোন সেতু বা ব্যারেজ ছিল না, লোকেরা নৌকা লঞ্চ এবং স্টিমার যোগে পারাপার হতো।
অদূরে মালদহের দিকে কালিয়াচক অবস্থিত কিন্তু আজকের কালিয়াচক নয়, অতি নগন্য ছিল, সেদিনের কালিয়াচক। সেই কালিয়াচক থেকে মাত্র দেড় মাইল উত্তরে ক্ষুদ্র সিলামপুর গ্রাম।
এই ক্ষুদ্র গ্রাম ভারত দেবভূমির অন্তর্গত।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল সৃষ্টি হয়। কিন্তু সব স্ফুলিঙ্গ থেকেই কি দাবানল সৃষ্টি হয়? হয় না- অধিকাংশ নিভে যায় এবং ছাই হয়ে ধুলোয় বিলীন হয়। কোন ভাগ্যবান স্ফুলিঙ্গ দৈব আনুকূল্যে হয়ে যায় বিরাট দাবানল। যে দাবানলে অনির্ব্বান লেলিহান শিখা জীবের পাপ-তাপ দাহ করে শান্তির পথ প্রশস্ত করে দেয়। তেমন এক ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল হয়ে আমাদের মাঝে দণ্ডায়মান রয়েছেন পরম আরাধ্য সিদ্ধ যোগীরাজ সাধক বঙ্কট বাবা। যিনি পুড়িয়ে দিয়েছেন বহু পাপীতাপী জঞ্জালকে। বঙ্কট বাবার শৈশব ইতিহাস খুব স্পষ্ট নয়- কারণ সন্ন্যাসীরা তাদের অতীত পরিচয় খুব কমই প্রকাশ করেন তবুও অন্তরঙ্গ ভক্তদের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে বঙ্কট বাবা যে টুকু বলেছেন সেই বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, উত্তর ভারতের কোন এক ব্রাহ্মণ রাজবংশে বঙ্কট বাবার জন্ম। সর্ব সুলক্ষণ, সুদর্শন, শিশু- পিতা মাতার নয়ন মনি ও অফুরন্ত আশা আনন্দের প্রতীক। হঠাৎ একদিন এক জ্যোতিষীর এসে বালক বঙ্কটকে দর্শন করে বললেন, হে রাজন আপনার এই পুত্র মহাভাগ্যবান। বেঁচে থাকলে এই ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ থেকে একদিন দাবানল সৃষ্টি হবে, কিন্তু দুঃখের বিষয়- শিশুটি স্বল্পায়ু। মাত্র ১২ বছর বয়োক্রম তার মৃত্যু হবে।রাজা ও রানী এই নিদারুণ বাণী শুনে মর্মাহত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন-হে জ্যোতিষাচার্য্য: এই শিশুর কি দীর্ঘায়ু হবার কোন উপায় নেই? জ্যোতিষী উত্তর দিলেন যে একমাত্র সাধুসঙ্গ ও সাধু কৃপাতেই দীর্ঘায়ু হতে পারে। অতঃপর জ্যোতিষী চলে গেলে শোকাতুর রাজা ও রানী আকুল চিত্তে ভগবানকে ডাকতে লাগলেন। আশ্চর্যের কথা শিশু বঙ্কট পঞ্চম বর্ষে পদার্পন করেই সাধু সঙ্গাভিলাসী ও ভগবত নাম শ্রবণ ও কীর্তনে উন্মুখ হয়ে উঠলেন। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় চতুর চঞ্চল শিশু তার পিতা মাতার মুখে একটা বিষাদের মলিন ছায়া লক্ষ্য করে বুদ্ধিমান ও সুচতুর বালক সুকৌশলে মায়ের নিকট থেকে তাদের দুঃখের কারণ জানতে পেরে বললেন- মা তোমরা দুঃখ করো না, তোমরা আমাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করো দেখবে আমি মৃত্যুকে জয় করবই! কিছুদিন সাধুসঙ্গ করার পরই আকুস মাছ রাজবাড়ী ত্যাগ করে ওই মেধাবী বালক নিরুদ্দেশ হলেন। পিতা-মাতা চতুর্দিকে শিশুর সন্ধান করে বিফল মনোরথ হলেন এবং তাদের জীবনে নেমে এলো অপ্রত্যাশিত এক দুঃখের ছায়া। দীর্ঘ ২৫ বছর পর সাধু সঙ্গ লাভের মধ্য দিয়ে মৃত্যুকে জয় করে তাদের হারানো দুলাল পূর্ণ যৌবন নিয়ে একদিন পিতা মাতার সম্মুখে উপস্থিত হল। তাদের হারানো নিধিকে বক্ষে ধরে জ্যোতিষীর কথা স্মরণ করলেন ও চিন্তা করতে লাগলেন আজ সেই স্বল্পায়ু স্ফুলিঙ্গ দিগন্ত উদ্ভাসিত করে বিরাট দাবানলের আকার ধারণ করেছে। অতঃপর রাজা বললেন, বৎস আজ তুমি সাধুসঙ্গের ফলে মৃত্যু সঙ্কট কেটে যখন বেরিয়ে এসেছো তখন আজ থেকে তোমার নাম বন্ কট বা "বঙ্কট"। ধন্য সেই পিতা মাতা যারা এমন পুত্র লাভ করেছেন; ধন্য সেই পুত্র যিনি পুরুষ আকারে নির্ভর করে সাধু সংঘ ও সাধু কৃপায় মৃত্যুকে অতিক্রম করে সামান্য স্ফুলিঙ্গ থেকে হয়েছেন দাবানল।
ঘর ছাড়ার ডাক, ভজনের ঘাটে যাবার ডাক, অমৃতত্ত্ব লাভের ডাক এদের বুঝি বিরাম নেই; আমরা মায়ামুগ্ধ ও বিষয়ী জীব তাই এটা আমাদের কর্নে পৌঁছায় না, যাদের কর্নে পৌঁছায় তারা গৌতম বুদ্ধ, চৈতন্যের মতো ঘর ত্যাগ করেন ও বিশ্বের মঙ্গলের জন্য যিশুখ্রিস্টের মত ক্রুশ বিদ্ধ হন। আজ কুমার বঙ্কটের কর্নেও সেই ঘর ছাড়ার ডাক পৌঁছালে তার মনে প্রশ্ন উদিত হয় যে, মাত্র সাধুসঙ্গের মাধ্যমে যদি মৃত্যুকে জয় করা যায়- তবে নিজে সাধু হয়ে সাধনা করলে ভগবান কে জয় করা যাবে না কেন? এই না ভেবে কুমার বঙ্কট সতত নিরানন্দ। পিতা-মাতা ওই রূপ দর্শনে বঙ্কটকে বললেন বৎস! তুমি এত নিরানন্দ কেন? শুধু শুধু তুই কি ভাবিস? ছেলে বললেন, আমি কি ভাবি শুনতে চাও? তাহলে শুন। শুধু সাধুসঙ্গের গুনে যদি মৃত্যুকে জয় করা যায়, তবে নিজে সাধু হয়ে সাধনা করলে ভগবান কে কি জয় করা যায় না! নিশ্চয়ই যায়। তোমরা প্রাণভরে আশীর্বাদ করে বিদায় দাও আমি সন্ন্যাস গ্রহণ করে ভগবানকে যেন জয় করতে পারি ও জগতের কল্যাণার্থে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারি। শ্রবনী পিতা মাতা আর্ত্ত কন্ঠে বললেন, অসম্ভব তুই যে আমাদের একমাত্র সন্তান ও নয়নের মনি। কোনমতেই আমরা তোকে সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দিতে পারব না বাবা। কুমার বঙ্কট বললেন, তোমরা ভুলে গেছো ১২ বছর বয়সে আমি তোমাদেরকে ছেড়ে চিরতরে অলক্ষ্যে হারিয়ে যেতাম আজ দেহে যে জীবন রয়েছে তা একমাত্র সাধুসঙ্গের দান অতএব তাদের সেবা করে, তাদের কৃপা নিয়ে আমি জন্ম ও জীবন সার্থক করব এবং সীমাবদ্ধ আয়ুকে অসীমে ছড়িয়ে দিয়ে তোমাদের পুত্র যুগজীবী হয়ে থাকবো। নিজে সিদ্ধিলাভ করে আর্ত মানুষের সেবা করে অমৃতের পুত্রদেরকে অমৃতের সন্ধান দেব।
পিতা-মাতা অনেক চেষ্টা করলেন ভোগের প্রলোভন দিয়ে, মায়া ও স্নেহের বাঁধনে সন্তানকে বেঁধে রাখতে কিন্তু শরীর নয় মন যার ছুটে চলেছে অমৃতের সন্ধানে তাকে বেঁধে রাখে সাধ্য কার? তাই দেখা গেল সর্ব্ব মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে বঙ্কট বাবা একদিন দৃঢ় সংকল্প নিয়ে মোক্ষলাভের সন্ধানে পুনশ্চ নিরুদ্দেশের যাত্রী হলেন। যথাক্রমে- ভজনের পাষাণ নদী ভেদ করে, ঈশ্বর সাগর সঙ্গমের যাত্রী হলেন।
ঈশ্বরের সন্ধানে বঙ্কট বাবা কিভাবে কোথায় ভজন করেছেন বা তাঁর সন্ন্যাস জীবনে গুরু কে কোথায় খুঁজে পেয়েছেন তার সম্বন্ধে কিছুই জানা যায়নি।
বঙ্কট বাবার সন্ন্যাস সাধনা ও সিদ্ধি লাভ তমসাবৃত। এ সম্বন্ধে বাবা কোনদিন কিছু বলেননি, তবে অন্তরঙ্গ ভক্তদের ধারণা যে বাবা প্রথমে হর-গৌরী সাধনা করতেন- আবার অনেকে তাকে নাকি শব সাধনা করতে দেখেছেন। তারঁ অলৌকিক কার্য্য-কলাপ দর্শনে স্থির সিদ্ধান্তে আসা যায় সাধক বঙ্কট বাবা তন্ত্রযোগ ও জ্ঞান মার্গে ভজন ও সাধনা করে অষ্ট সিদ্ধি লাভ করেছেন। অবশ্য লোকালয়ে প্রকট অবস্থায় দেখা গেছে তিনি প্রেম পথের বাৎসল্য রসের সাধনায় গোপালের সেবা করতেন। সর্ব্ব পথের সাধনায় সিদ্ধ থাকায় তিনি সব মানুষের মাঝেই বিশ্বব্যাপী এক ভগবানকে দর্শন করেছেন তাই তার কাছে কোন জাতিভেদ ছিল না। দ্বিধাহীন চিত্তে সাত্বিক মুসলমানের বাড়িতেও দুগ্ধ ফলমূল সেবা করতেন; অবশ্য তিনি কখনও কারও বাড়িতে অন্ন গ্রহণ করতেন না।
নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্ম বেদোক্ত ভগবানের সাধনা করে ও তন্ত্রোক্ত শক্তি সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেও শেষ জীবনে কেন যে তিনি গোপালের সেবায় দিনাতিপাত করেছেন এ প্রশ্ন সবার মনে আসতে পারে এর উত্তরে আমরা বাংলার গৌরব সিদ্ধ গুরুঠাকুর নিগমানন্দ সরস্বতী দেব স্মরণ করতে পারি। প্রথমে তারাপীঠে বামাক্ষ্যাপার কাছে তন্ত্র মতে শব সাধনা করে জগৎজননী মা কে দর্শনণ করেও তৃপ্ত হতে পারেননি। তাই ক্ষ্যাপার নির্দেশে জ্ঞানী গুরু সচিদানন্দ পরমহংসের ভজনা করে ব্রহ্ম উপলব্ধি করেন তবুও তার মন তৃপ্ত হলো না, সর্বশেষে প্রেমিক গুরু গৌরী মার কাছে প্রেমপথে সাধনা করে তিনি পরম শান্তি লাভ করেন এই প্রেমের ভজন ছাড়া পূর্ণানন্দ হয় না।
তাই ভজনের চরমাবস্থায় আসে প্রেমের সাধনা ভগবানের সঙ্গে একটা নিকট সম্বন্ধ করে তাকেঁ কাছের মানুষ করে নিয়ে প্রেম পথে ভজন এর মাধ্যমে পূর্ণানন্দলাভ করা। যেমন করেছেন বৃন্দাবনের রাধারানী, মা যশোদা ও রাখাল বালকগন। এদের কারো কাছে শ্রীকৃষ্ণ ভগবান নন। পরমাত্মীয় কারো কাছে প্রাণবল্লভ, কারো কাছে পুত্র আবার কারো কাছে ভ্রাতা- একেই বলে রাগাশ্রয়ী ভজন। যে ভজন দক্ষিণেশ্বরে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ভগবানের সঙ্গে মাতা-পুত্রের সম্বন্ধ স্থীর করে মা মা বলে আকুল হয়ে ডেকে তাকে মা রূপের সাধন করেন।
আমাদের বঙ্কট বাবাও তাই করেছেন। সর্ব্বপথে সিদ্ধ হয়ে ও শেষ জীবনে তিনি ভগবানকে গোপাল রূপে সেবা করে বাৎসল্য রসের আস্বাদন করেছেন, সাধনার পূর্ণতা এইখানেই। মহামুনি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদ কে ব্যাস করে মানে ভাগ করে যিনি হলেন বেদব্যাস (বেদ + ব্যাস)। তিনি বহু শাস্ত্র রচনা করেন অষ্টাদশ পুরাণ রচনা করে ও মন্ত্রিত্ব হলো না তখন তার গুরু দেবর্ষি নারদ এর আদেশে শ্রীমৎভগবদ্ ( বৃন্দাবনের প্রেমরসলীলা) রচনা করে জীবন পাত্র অমৃতানন্দরাস পূর্ণ করেছেন। এই হচ্ছে ভজনের জীবনদর্শন। সাধক বঙ্কট বাবা তারই জীবন্ত আলেখ্য।
সাধকদের মধ্যে দুই শ্রেণীর সিদ্ধপুরুষ বর্ত্তমান।
আত্মকেন্দ্রিক:- ঈশ্বরকে লাভ করে অমৃত রস পান করে নিজে বিভোর হয়ে থাকেন, বিশ্বের চিন্তা করবে এমন অবসর তাদের নেই।
গোষ্ঠীকেন্দ্রিক:- এরা নিজেকে নিয়ে বিভোর থাকেন না। এরা চান বিশ্বের কল্যাণ, ত্রিতাপ জালায় জর্জরিত মানুষকে শান্তির পথ দেখাতে ও তারা যে অমৃত রস পান করেছেন মায়া মুগ্ধ বিষয়ী জীব সবাই সেই অমৃত রস পান করুক এবং বদ্ধজীব বন্ধন মুক্ত হোক্। সাধক বঙ্কট বাবা এমনই গোষ্ঠীকেন্দ্রিক মহাপুরুষ লোক চক্ষুর অন্তরালে কত বছর যে সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেছেন তা জানা সম্ভব হয়নি। লোকে বলে সাধক বঙ্কট বাবা ৪০০ (চারশত) বছর জীবিত ছিলেন, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই কারণ চলন্ত শিব শ্রী শ্রী তৈলঙ্গস্বামী ২৭৪ বছর বেঁচে ছিলেন, জন্ম ১৬০৭ খ্রী: দাক্ষিণাত্যের তেলেঙ্গানায় বিজয়নগর রাজ্যের হালিয়া গ্রামে, দেহ রক্ষা করেন- কাশিতে ১৮৮১ খ্রী:।
কাশির ছোট পরমহংসদেব ৩০০(তিনশত) বছর বেঁচে ছিলেন, তারঁ গুরু আরো বেশি জীবিত ছিলেন (তাপস গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বার্ধক্য বারানসী থেকে)।
গোবরজনা (আড়াই ডাঙ্গা) গ্রামে একটি অবস্থাপূর্ণ পরিবারের বৃদ্ধ ব্যক্তির নিকট শুনেছি যে, সাধক বঙ্কট বাবা নীলাচলে কুঠির মধ্যে থাকা কালীন যখন মহাপ্রভুর নিলাচলে গমন করেন, তৎকালে একরাত্রি ওই বাবার কুঠিরে নিশি যাপন করেন (ভারতের সাধক গ্রন্থে প্রমাণিত) এই সূত্রে বাবার বয়স ৫০০(পাঁচশত বছর) প্রতিত হয়। তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ ভারতের সিদ্ধপুরুষেরা অনেকেই ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেছেন। যেমন মহাভারতে উল্লেখিত ভীষ্ম দেব শরশয্যায় ইচ্ছা মৃত্যু বরণ করেছেন। এদের বলা হয় মৃত্যুঞ্জয়ী পুরুষ। যেমন বঙ্কট বাবা মহাপ্রয়াণ দিবসে নিষ্প্রাণ দেহে সিলামপুরে শায়িত, আবার স্হূলদেহে খেজুরিয়া ঘাটে ভক্তের দর্শন- এর মর্ম্মার্থ কী? এমনতর সাধক পুরুষদের দেহত্যাগ শুধু জৈবিক লীলা, নইলে এরা অমর। মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্কট বাবা শতাধিক বর্ষব্যাপী কঠোর সাধনার মাধ্যমে সিদ্ধিলাভ করে যখন আনন্দ রসে বিভোর তখন তার কর্ণে গেল এক অস্ফুট ক্রন্দন ধ্বনি।
কে কাঁদে? তৃতীয় চক্ষু (জ্ঞানচক্ষু) উন্মিলন করে দেখলেন আধ্যাত্ম ভারতের আর্ত্তজীব ঈশ্বর বিমুখ হয়ে বিষয়ে বিষের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে ছটফট্ করছে এ তাদেরই বোবা কান্না, বিশ্বহিতকামী বঙ্কট বাবার প্রেমিক মন চঞ্চল হলে, তিনি তপস্যার বেদি থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি সংকল্প করলেন আর্ত মানুষের সেবা করতে হবে ও জড় ও বিজ্ঞানের চাপে শ্বাস রুদ্ধ মানুষদেরকে আধ্যাত্ম পথের সন্ধান দিতে হবে। তখন শুরু হলো তার ভারত পর্যটন বহু রাজ্য ঘুরে তিনি জানলেন ও বুঝলেন সাধন-ভজনের দিক দিয়ে বঙ্গদেশই সবচাইতে পশ্চাতে। করুণাময় বাবা মালদহ জেলার কালিয়াচক থানার অন্তর্গত নিমতলা শ্মশান ঘাটে ধূনী জ্বেলে বসলেন। স্বর্ণ কান্তি, দীর্ঘদেহ, যথাযথ সমন্বিত, আজানুলম্বিত অর্ধনগ্ন এই সন্ন্যাসীকে ধীরে ধীরে ধীরে বেশকিছু ভক্তের সমাগম হতে লাগল। শ্মশানের অদূরে সাহেবদের নীলকুঠি। বাবার ক্রিয়া-কলাপ বড় সাহেবের চোখে পড়লে তার ভালো লাগলো না এবং বাবাকে ভন্ড জুচ্চোর বলে তিরস্কার করতে লাগলো। এমনকি গোপনে লোক নিযুক্ত করল। সর্বজ্ঞ বাবার অবগত হতে বাকি রইল না।
হঠাৎ একদিন মেম সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লে বড় বড় চিকিৎসক রোগ নির্ণয় অপারগ হলে ক্রমে ক্রমে মেমের দেহাবসান ঘটার সম্ভাবনা হলো। সাহেব তখন প্রিয়তমার অকাল মৃত্যুর আশঙ্কায় অধীর হয়ে ক্রন্দন করতে থাকলে সেথায় কর্মরত বাঙালি কর্মচারীরা বলল, নিমতলা শ্মশানের সাধুকে একবার ডেকে এনে দেখান। সাহেব- ওকি ডাক্তার? একজন বয়স্ক বাঙালি বললো, উনি একজন সিদ্ধপুরুষ, সাধু সন্ন্যাসীদের ঐশ্বরিক ক্ষমতা মৃত্যুকে প্রাণ দিতে পারে। সাহেব- আমি ঐসব সাধুটাধু মানিনা। কিন্তু ক্ষণিক পরে মেম সাহেব বললো গিয়ে সাধু কে নিয়ে এসো নচেৎ আমি বাঁচবো না।
অগত্যা সাহেব তখন বঙ্কট বাবাকে অনেক সাধাসাধি করে আনলে বঙ্কট বাবা গর্জন করে বললেন, সাহেব তোমার অহং এবং ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা রয়েছে, তাই তোমার পত্নীর অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে; যদি তাকে বাঁচাতে চাও তবে ভগবানের চরণে আত্মসমর্পন করো এবং ভারতীয় সাধনাকে শ্রদ্ধা জানাতে শিখ। কি আর করেন দ্বায়গ্রস্ত হয়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে সাহেব বললো, বাবা আমাকে ক্ষমা করুন সাহেবের নয়নে শ্রাবণের ধারা ঝরছে তখন বঙ্কট বাবা আপন কমন্ডুল হতে জল নিয়ে মন্ত্র পুত: করে মেম সাহেব এর গাত্রে ছড়িয়ে দিলে মেম রোগ মুক্ত হলো। সাহেব আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগল একি ভোজবাজি? বঙ্কট বাবা বললেন, ইহা ঐশ্বরিক কৃপা এবং তারঁ অর্থাৎ ঈশ্বরের দান। আনন্দিত হয়ে সাহেব প্রচুর অর্থ বাবাকে দিতে চাইলে বাবা বাধা দিয়ে বললেন, না সাহেব এ অর্থের আমার প্রয়োজন নেই, যদি দিতে পারো ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে শ্রদ্ধা ও ভক্তি দাও। ধর্ম কে ভালোবাসো, ঈশ্বরের মূর্ত প্রতীক সাধু সন্ন্যাসীদের শ্রদ্ধা করে বুক ভরা প্রেম দাও আরো পার তো পূর্ণ আত্মসমর্পন করো। অতঃপর সাধু বেরিয়ে পড়লেন।
এ কাণ্ডের-পর চতুর্দিকে সাধুবাবার সুকৃতি ছড়াতে লাগলো, সেদিনের জয় বঙ্কট বাবার জয়ধ্বনি- যে ধ্বনির আজও বিরাম নেই, তারঁ কৃপা বর্ষণের বিরাম নেই, তবে তিনি অপ্রকট। সাহেব প্রার্থনার স্বরে বলল, হে ঈশ্বর! আমি ভবদীয় চরণে আত্মসমর্পণ করে, প্রতিজ্ঞা করে বলছি, আজ থেকে সাধু সন্ন্যাসী কে ও তোমার গুন -গানের শ্রদ্ধা দেব তুমি আমার প্রিয়তমার ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করে দাও।
নীলকুঠির এই অলৌকিক কাহিনী ছড়িয়ে পড়ার দরুন নিমতলার শ্মশান ঘাট ক্রমশ: লোকারণ্যে জমে উঠতে লাগলো। কিন্তু বঙ্কট বাবা লক্ষ করলেন সাধন-সিদ্ধি প্রেমিকের চেয়ে গঞ্জিক সিদ্ধি প্রেমিকের ভিড় বেশি। তাই সাধু বাবা এক নিশিতে উক্ত নিমতলা ঘাট পরিত্যাগ করে, থানার অদূরে বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে ডেরা ফেললেন। একদিন গভীর রাত্রে তিনি শব সাধনায় রত,( স্থান:- কালিয়াচক থানার সংলগ্ন শ্রী শ্রী দুর্গা মণ্ডপের পশ্চিম প্রান্তে (ঠুঁঠিয়া) নদীর ছাড়ান- অথচ তখন উক্ত শ্মশান টি প্রবাহিত গঙ্গার সঙ্গে যুক্ত ছিল) হঠাৎ বাবার নজরে পড়লো যে, একটি পুলিশ গোপনে তাকে দেখছে বাবা ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশকে বললেন, তুম মুঝে চোর কে মাফিক্ দেখ্ লিয়ে, যা তেরা জীবন খাতরা হোগা! ব্যর্থ হয়নি সাধকের বাণী উক্ত রাত্রেই পুলিশটি রক্ত বহন করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তারপর বাবা নানারূপ চিন্তা করে স্থির করলেন যে এই স্থানে থাকা চলবেনা। অতঃপর তিনি উত্তরাধি মুখে যাত্রা শুরু করেন এবং অতি প্রত্যুষে সিলামপুর গ্রামে এসে উপস্থিত হন।(কালিয়াচক থানা হতে দেড় মাইল উত্তরে)
জয় বাবা বঙ্কট, অনুগতের সন্নিকট।
যে রাখে চিত্ত অকপট, তার তরেই প্রকট।।
মহৎ এর নাই বিকাশ শুদ্ধ-সত্ত্ব ঘট।
অহ:রহ বিরাজিত নিত্যানন্দ নিকট।।
সিলামপুর তীর্থ হলো
ভাবার্থ :-
তিলক, মালা, শিখা, কৌপিন বহির্বাস।
সৎ- এর সঙ্গতি যে কাশির নিবাস।।
এই পঞ্চটি নিদর্শন বঙ্কটের ছিল।
তাই সিলামপুর তীর্থ বর্ণন হলো।।
কে জানিত কে চিনি তো ক্ষুদ্র এই গ্রাম। বঙ্কট বাবাকে পেয়ে, হলো তীর্থধাম।।
যার চরণ স্পর্শে হলো যে মহান।
সেই বঙ্কট বাবার নামে হচ্ছে জয়গান।।
রাতের আঁধার তখনও সম্পূর্ণ কাটেনি, পাখিরাও নিজ নিজ বাসা ত্যাগ করেনি সেই প্রত্যুষে সিলামপুর গ্রামে এই অলৌকিক শক্তিধর সন্ন্যাসীর পদার্পণ প্রাক্কালে, গ্রাম্য জনৈক ইষ্টনিষ্ঠ ভক্ত শ্রীহরিলাল সাহা ঘটি নিয়ে স্নান ও শৌচের নিমিত্তে গমন পথে অপূর্ব সন্ন্যাসীকে মেঘাচ্ছন্ন গানের অকস্মাৎ রক্তিম দিবাকরের মত দর্শন করে ভাবলেন, আজ আমার কি সৌভাগ্য এহেন সুপুরুষ যেন ঈশ্বরের মূর্ত্ত প্রতীক তারঁ দর্শন পেলাম অতঃপর অবিলম্বে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে জিজ্ঞেস করলেন, "সাধুবাবা আপ্ কাঁহা সে ইতনাহি সবেরে মে আ রহেঁ হ্যাঁয়? সাধু- ম্যায়নে এহি শৌচ কার আয়া, যিসসে আগারী ভেট্ হোগা ওহ, পর ডেরা ফেকুঙ্গা। আজানু লম্বিত ভূজ সুদীর্ঘ কলেবর মস্তকে জটাজুট করে কমণ্ডলু ও চিমঠা, চরণে পাদুকা, তিলক, মালা, শিখা, কৌপিন, বহির্ব্বাস পঞ্চটি নিদর্শন ও স্কন্ধে ঝুলি বিরাজমান। এহেন রূপ যার নয়নে পড়েছে সেকি আর নয়ন ফেরাতে পারে? স্বগতঃ জানিয়ে বললেন, বাবা আপ্ কৃপাসে এহাঁ পর ডেরা ফেকিয়ে! সন্ন্যাসী সম্মত হলে হরিনাম করতে করতে হরিলাল নিজাঙ্গনে, বাবা কে প্রতিষ্ঠা করে ধন্য হলেন।
সাধু বাবা প্রত্যহ ব্রাহ্ম মুহূর্তে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক স্নান, অহ্নিক ও গোপালের সেবা অর্চনা করতেন। মধুর লোভে অলি বা ভ্রমর যেমন ফুলে ফুলে মধু আহরণ করে বেড়ায়, তদ্রুপ ভক্তবৃন্দ তাপস্ প্রবর সাধু বাবাকে ঘিরে বসতো। ক্রমে ক্রমে ভক্ত মন্ডল এর সংখ্যা বাড়তে থাকে ভক্তদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বাবা বলতেন, ম্যাঁয়নে রামচান্দার্ জীকা শাদি দেখা থা। ইহা কি বিশ্বাসযোগ্য? অসম্ভব নয় কি? ক্রেতার লীলা দর্শন কলিযুগে বসে ! কোন কোন জ্ঞানী গুণী উক্তি করেছেন যে তা অসম্ভব নয়। যদি ভগবান কে একচিত্তে আত্মসমর্পণ করে সাধনা করা যায়, তাহলে অসম্ভব ও সম্ভব হয়। সুকৃতি বশে কোনও ভাগ্যবান পূর্ব জন্মের কথা জ্ঞাত হয়ে ব্যক্ত করতে পারেন উহাকে জাতিস্মর বলা হয়। বঙ্কট বাবাকে জাতিস্মর বললে অত্যুক্তি হয় না।
ত্রিকালজ্ঞ বাবা বঙ্কট, ত্রিগুণাতীত ।
তাই জ্ঞাত ছিলেন, স্মৃতি যা অতীত ।।
সৎ সঙ্গ গুনে আর- সাধনার বলে।
অসম্ভব কার্যযোগী, করে অবহেলে ।
ত্রিকালজ্ঞ ঋষি করেন জীবের কল্যাণ ।
ভূত ভবিষ্যৎ বার্ত্তা, করেন প্রদান ।।
জড়তা আর মোহ মায়া ক'রে অবসান ।
জীবের মঙ্গলে করেন শুভাশিস দান ।।
সাধু বাবার জ্যোতির্স্ময় রূপ প্রিয় সম্ভাষণ হিন্দু, মুসলমান, ব্রাহ্মণ ও শুদ্রদের সমজ্ঞান ভাব এবং অলৌকিক বাক্যালাপ ও কার্যকলাপ গ্রামটাকে ধন্য করেছে। নিত্য ভগবৎ প্রসঙ্গ কীর্তন আনন্দে মুখরিত থাকতো। অদ্যবধি আমাদের ছোট্ট গ্রামে এই বৈশিষ্ঠ বিরাজমান বঙ্কট বাবার প্রাঙ্গন আজও যেন শ্রীবাসাঙ্গন। দূর-দূরান্ত হতে সাধু ও ভক্তরা এই স্থানে আসেন এবং অনুক্ষণ বঙ্কট বাবার গুনগান করতে ব্যস্ত থাকেন।
ভক্তগণ :- বাবার নিকট উপদেশ চাইলে বাবা বলতেন, মন্ কো বশ্ মে আন্, যো রূপ তুমকো আচ্ছা লাগে ওহী রূপ মে ধ্যান লাগা কর্ ঈশ্বর কো প্যায়ার করো অন্দার দর্শন। ভেদ না করো, তবে বাচ্ পান কে মাফিক্ সরলতা সে ভগবান জীকা দয়া লাভ হোতা। এহি বাত্ কো ইয়াদ্ রাখ্ না। গোঁড়া নাহি- গোরা হোনা চাহিয়ে সৎ-কো অনুস্মরণ উন্মত, অউর অবিশ্বাসহি অবনত। মানো তো দেব, নাহি তো পাথ্বার, অনিত্য কা ত্রাণ কে লিয়ে, নিত্য ক্রিয়া করনাহি চাহিয়ে। এমনও তর আলাপ-আলোচনা অহর্নিশি চলত। যাদের সৌভাগ্য হয়েছিল সিদ্ধ মহাযোগীর সংস্পর্শ লাভ করা ধন্য তারাই.....
বঙ্কট বাবার লীলা অতীব মধুর ।
শ্রবণে জীবের পাপ হয়ে যায় দূর ।।
ভক্তিভাবে যে বা তার নাম গান গায় ।
দেহান্তে সে ভক্ত সদা মোক্ষধাম পায় ।।
প্রশ্ন হতে পারে তদুত্তরে নিম্নে দেওয়া হল ।
পরাশর মুনি সুতে, নিজাসন দিয়া ।
ভ্রমন হেতু অন্যত্র গেলেন চলিয়া ।।
ইত্যাবসরে বলরাম তথা আসিলে ।
অন্যান্য মনি সব অভ্যর্থনা আপিলে ।।
সুত কিন্তু না ত্যাজিলো গুরুর আসন ।
বলরাম ক্রুদ্ধস্বরে বলিল তখন ।।
আরে রে সুতো তোর এত অহংকার ।
আমারে না মানিলে করিব সংহার ।।
এত বলি খড়্গ হস্তে বধিল তাহারে ।
হেনকালে পরাশর উপস্থিত দ্বারে ।।
কি করিলে বলরাম ব্রহ্মহত্যা পাপ।
বলরাম:- দিয়েছি, অবজ্ঞার ই দাপ ।।
আমারে দেখিনা কৈল, অহংত্র প্রণাম ।
মুনি- আসন ত্যাজিলে, গুরুর দূর্ণাম ।।
বিষ্ণু অংশ বলরাম, সুত সাধারণ ।
ভক্তে ভগবানের বাস তার-ই বচন ।।
অতএব ভক্তানুস্মরণকারী মুক্তি পেয়ে থাকেন।
প্রায় ভক্তরা দেখতো বাবা মধ্য রাস্তায় বসে পায়খানা করছে কিন্তু ভক্তরা কোনদিন বাবার মল দেখতে পেত না এবং রাস্তায় মলত্যাগ করার জন্য কেউ প্রতিবাদ করত না বরং অলৌকিক কার্যকলাপ দেখে বাবাকে শ্রদ্ধা করতো।
একদিন এক প্রশস্ত রাস্তায় বসে বাবা মল ত্যাগ করছেন। এমন সময় এক ইংরেজ অফিসার মোটর চালিয়ে ওই রাস্তা দিয়ে চলেছে। পথের মাঝে সাধুবাবাকে বসে থাকতে দেখে সাহেব বারবার হর্ণ দিচ্ছে, তবু সাধুবাবার তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই।
একটি ন্যাংটা অর্ধনগ্ন সাধুর এই ব্যবহারে সাহেব মেজাজ গরম করে গালিগালাজ করলো এবং ভয় দেখিয়ে বললো, শীঘ্র পথ ছেড়ে না দিলে তোমার উপর দিয়ে মটর চালিয়ে যাব। কটু কথা শ্রবণ করে বাবা নিরব ও নিশ্চল রইলেন। অতঃপর দাম্ভিক সাহেব বাবার উপর দিয়ে মটর চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। অকস্মাৎ গাড়ি স্টার্ট বন্ধ হলো কিন্তু কি আশ্চর্য বার বার চেষ্টা করেও গাড়িতে আর স্টার্ট নেয় না। অবিলম্বে অবতরণ করে কলকব্জা নেড়েচেড়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ ও হতবাক হয়ে ঘর্মাক্ত শরীরে চিন্তা করতে লাগলো। ইতিমধ্যে সাধুবাবা শৌচ সমাপ্ত করে সাহেবকে বললেন, কা সাহেব! গাড়ি চালাইয়ে ! তখন সাহেবের মনে হল এই ন্যাংটা সাধুর কাজ, ভোজবাজির দ্বারা আমার গাড়ি অচল করেছে। তখন সাহেব অবনত মস্তকে সাধুর নিকট ক্ষমা ভিক্ষা চাইলে সদা প্রসন্ন বাবা বললেন, এইসা অন্যায় কাভি নাহি করনা, ইয়াদ্ রাখ্ ইয়ে দেব ভূমি ভারত মে, কিতনা বড়া বড়া যোগী ঋষি হ্যায়, সাধু কো কভি অপমান করনা, অন্যায় বোলনা তো বহুৎ নোক্ সান হোগা ! তারপর সাধু বাবা মোটর চালিয়ে যাবার অনুমতি দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন চালু হলে সাহেব মাথা নুঁইয়ে প্রণাম জানিয়ে চলে গেল। শোনা যায় ওই সাহেব জীবনে নাকি কোন সন্ন্যাসী কে কক্ষনো আর অপমান করেননি। বাবার কত অসীম শক্তি, তাই জড় পদার্থও বাবা কে মানতো এবং বাবার আজ্ঞাবহ ছিল। এই ঘটনার পর বাবার নাম প্রবলভাবে ঝড় বা উল্কার গতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পরলো।
বঙ্কট বাবা নিত্যগোপাল এর সেবা করতেন। একদিন দুধ আনতে বিলম্ব হলে ক্রোধানলে বাবা গোপালকে আঘাত হেনে বললেন, খানা লেকে আও! দুধ কাহাঁ ? সবাই - এই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে হায় হায় করে উঠে ভাবলো যিনি জগতের ঈশ্বর, তাঁর এত অপমান ! এমন সময় এক ভক্ত দুধ নিয়ে উপস্থিত হয়ে প্রনাম করে বাবার হস্তে অর্পণ করলেন। বাৎসল্য প্রেমের কি অপূর্ব লীলা, মা যশোদা যেমন গোপালকে বাৎসল্য ভাবে ভালোবাসতেন আবার শাসন করতেন তার জন্য গোপাল ক্রুদ্ধ না হয়ে বরঞ্চ মাকে আরো শ্রদ্ধা দিতেন।
এক্ষেত্রে বঙ্কট বাবা বাৎসল্য ও প্রীতির জন্য কপালে আঘাত দিলেও তিনি গোপালের কৃপা ভাজন ছিলেন। শোনা যায় ভাবাবিষ্ট বামাক্ষ্যাপা কখনো কখনো আরাধ্যা তাঁরা দেবীর গাত্রে প্রস্রাব করে দিতেন। পূজারী ও ভক্তরা তা দেখে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ও অভিযোগ তুললে- মা তারা স্বয়ং স্বপ্নযোগে জানিয়েছেন, ছেলে মায়ের গাত্রে প্রস্রাব করলে তা কি হয়েছে? মা কি তা উপেক্ষা করতে? পারে জগত জননী ও জগদীশ্বর সকলেই ভক্তাধীন। গোপালের সঙ্গে বাবার ও বাৎসল্য রসের তেমনি নিবিড় ও ভাব্ ছিল।
প্রতিদিন সাধু বাবাকে ফল, দুধ, ছানা, দধি ক্ষীর ও গাজাঁ প্রচুর পরিমাণে ভক্তরা দিয়ে ধন্য হতো। বাবা অর্চ্চান্তে প্রসাদ ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করতেন। ভক্তগণ অনেকেই প্রসাদ এর মধ্যে পোকা দেখে বলতো বাবা এই প্রসাদে পোকা হয়ে গেছে, বাবা তখন ক্ষুব্ধ হয়ে বলতেন, কাহা পিল্লু ? শালা খা লে! যারা অনুরাগী তারা ভক্তি ভরে পান করে অমৃত স্বাদে ধন্য হতো, আর যারা রুচি বিকারে প্রতিবাদ তুলত তারা বিফল পেতো। ভক্তিভরে প্রসাদ ভক্ষণ করে অনেকেই ব্যাধি মুক্ত হয়েছে। অদ্যাবধি এই প্রসাদ মাহাত্ম্য আছে।
প্রসাদে রুচি বিকারের প্রতিফলস্বরূপ সারাবলী থেকে "কালীয় নাগ" বিবরণ এখানে উদ্ধৃত করা হলো। কালীয় নাগ পূর্ব জন্মে চন্দ্রধ্বজ রাজা ছিলেন। একদা মৃগয়া হতে একটি সঙ্গীসহ রাত্রে অরণ্য মাঝে কোন এক হরি মন্দিরে আশ্রয় নিলেন। উক্ত মন্দিরে পূর্ব থেকেই ধর্মরাজ ছলনা নিমিত্তে, গলিত কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তীব্র গন্ধ তবুও দয়াশীল রাজা সঙ্গীসহ কোথায় রইলেন। কিন্তু ভগবানের অলৌকিক লীলা জীবের বুঝা ভার। অধিক রাত্রে রাজা তীব্র গন্ধে আকুল ও কাতর হয়ে রাগান্বিত স্বরে সঙ্গী কে বললেন, এই হতভাগা মুনিটাকে ঐ গাছতলায় রেখে আয়। যখন মুনিকে ঘর থেকে বের করছে এমন অবস্থায় মুনি বললেন, রাজা তুমি অতি দয়াবান কিন্তু তোমার অন্তরে খল বসে আছে, এই দুষ্ট বুদ্ধি তোমাকে গ্রাস করেছে। তাই নির্দ্বিধায় আমার অপমান করলে। এই জন্য আমি তোমাকে অভিশাপ দিলাম- পরজন্মে তুমি সর্পযোনি প্রাপ্ত হবে। রাজা দুঃখ নিয়ে বাড়ি ফিরে উক্ত বিবরণ পার্ষদগনে তুলে ধরতেই যার যা বিহিত ব্যবস্থা দিলেন। ইত্যবসরে শরদ আসলে এই বিবরণ জ্ঞাত হয়ে বললেন, রাজা তুমি রাজহংসের মাংস ভক্ষণ কর, তবে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে।
এ কথা শুনে রাজা একটি অংশ ধরলে, হংশটি প্রশ্ন করল, তুমি আমাকে মেরে কি লাভ করবে? রাজা তার অভিশপ্ত কথা ব্যক্ত করলে, হংস- তুমি নির্ব্বোধের ন্যায় আমাকে হত্যা করবে, কোথায় শুনেছ হংস মাংস ভক্ষণে অভিশাপ মুক্ত হয়? আমি যা বলি তুমি তা করলে মুক্তি পাবে। অতঃপর রাজা জানতে চাইলে হংস বলল, তুমি যার নিকট অপরাধী তার চরণামৃত পান করলে মুক্ত হবে। এ কথা স্মরণ করে রাজা বনে গিয়ে মুনি অগ্ৰে করজোড়ে দন্ডায়মান হয়ে প্রার্থনা জানালেন। মুনিবর প্রসন্ন হয়ে দৃষ্টিপাত করে রাজাকে বললেন, তুমি কি চরণামৃত পান করতে পারবে? রাজা- আমি নিশ্চয়ই পারবো। মুনি তখন পা এগিয়ে দিলেন সেদিন আরো প্রচুর পরিমাণে রক্ত পুঁজ হচ্ছে। রাজা উক্ত চরণামৃত হস্তে নিয়ে অঝোর নয়নে কাঁদতে কাঁদতে ঈশ্বরকে প্রার্থনা জানালেন, হে করুনাময় ভগবান, আমি এই চরণামৃত পান করতে পারলাম না, আমি মস্তকে ধারণ করলাম তুমি যা করো। মুনি ওই রূপ দর্শনে বললেন, মহারাজ তুমি সর্বজনি হতে মুক্তি হতে পারলে না তবে তোমার মস্তক পবিত্র হল। প্রভু দা পড়ে কৃষ্ণ অবতার হয়ে তোমার এই পবিত্র মস্তকোপরে নিত্য করবেন। রাজা ইহা শ্রবণ করে আনন্দচিত্তে বললেন, মুনিবর হোক সর্পযোনী তাতে বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই, যদ্যপী প্রভু আমার মস্তকে নিত্য করবেন তবেই আমি ধন্য হবো, যুগ যুগ ধরে তপস্যা করে যোগী মুনি ঋষিরা যে চরণ দর্শন পায় না, আমি উহা অনায়াসে প্রাপ্ত হব এবং মস্তকে বহন করবো।
এ গল্প হতে বুঝা যায় যে ভক্তি ভরে প্রসাদ ভক্ষণ করলে জীবের অভিশাপ দূর হয় আর রুচি বিকারে ভক্তি থাকা সত্ত্বেও পূর্ণাঙ্গ মুক্তি পাওয়া যায় না।
বঙ্কট বাবার ক্ষেত্রেও তদনুরূপ-
প্রসাদ গ্রহণে মুক্তি।
রুচি বিকারে সর্ব্বনাশ তাই কালীয়নাগের উক্তি ।।
যার বিষে জর্জরিত, পশুপাখি আদি যত
আর্ত্ত হাহাকারে।
সে কালীয়নাগ শিরে, বাসুদেব নৃত্য করে, উদ্ধারিল দয়া করে তারে ।।
এই সিলামপুর গ্রামের স্বনামধন্য জমিদার শ্রী রাখাল চন্দ্র বন্দোপাধ্যায় বঙ্কট বাবার অনুরাগী ভক্ত ছিলেন। তার বাড়িতে শ্রী শ্রী রাধা বিনোদের বিগ্ৰহ স্থাপিত যা অদ্যাবধি রয়েছে। উক্ত বিগ্ৰহ- প্রসাদ "বাবা" কোন কোনও দিন আপন খেয়াল-খুশিমত গিয়ে সেবা নিতেন। একদিন উক্ত ভক্ত বাড়িতে প্রসাদ সেবা নেওয়ার নিমিত্তে বসতেই বাবা হঠাৎ উঠে গিয়ে বললেন তেরাডেরা অছ্যুৎ হো গ্যায়া ! অতঃপর নিজাঙ্গনে ফিরলেন সকলেই এই কান্ড দেখে হতভম্ব হলো, ইত্যবসরে ডাক্ পিয়ন চিঠি নিয়ে দ্বারে উপস্থিত হলে উক্ত টেলিগ্রাম পাঠ করে জ্ঞাত হলেন যে, বন্দ্যোপাধ্যায় বাবুর নিকটাত্মীয় পরলোকগমন করেছেন। এই জন্য তারা অশৌচ হয়েছেন। সর্বজ্ঞ বাবা তাই জানতে পেরে বলেছিলেন।
ত্রিকালজ্ঞ সর্বদর্শী হে ঋষি প্রবর ।
অনুরাগে স্মরণার্থীর পবিত্র অন্তর ।।
সাধক বঙ্কক বাবা পবিত্রতা মানতেন। কিন্তু জাতি ও শ্রেণীভেদ তার ছিল না। অনেক সময় ধার্মিক সৎ ও নিষ্ঠাবান মুসলমানের রান্না ঘরে ঢুকে উনুন হতে কমন্ডুল ভরে গরম দুধ নিয়ে এসে পান করতেন। সাধুবাবার ওই গৌরব মূর্ত্তি দর্শনে অন্তঃপুর হতে নারীগণ পলায়ন করতো। অনেক গৃহস্বামী এজন্য দুঃখিত ও চিন্তিত হত, কেননা হাড়ি ও উনুন কোন অবস্থায় আছে, বঙ্কট বাবা সেই দুধ নিয়ে গিয়ে সেবা করেছেন তাই অনেকে বাড়িতে সাবধান করে বলতো দেখ- তোমরা এখন হ'তে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অবলম্বন করো, নচেৎ আমাদের পাপ হবে, না জানি বাবা আমাদের বাড়ি কোন দিন চলে আসবেন এই জন্যই সতর্কবাণী বলতো। এইভাবে বাবার কর্ম বাবার মূল উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ছিল যে অনুভূতি সূত্রে জীবের চৈতন্য লাভ করানো আর অন্যদিকে একাত্মতা অভেদে ভজন করা।
সর্ব্ব ভূতে বিরাজিত একই ভগবান ।
শাস্ত্রোক্তি মিথ্যা নয় দ্বিধাহীনে দর্শন ।।
সাধুবাবা কমণ্ডলু নিয়ে মাঝে মাঝে ভিক্ষায় বের হ'তেন, এবং প্রায় মিঞাঁ পরিবারে (আকবর আলী মিঞাঁ, বাবর আলী মিঞাঁ) গিয়ে দুধ ইত্যাদি নিয়ে আসতেন তারাও দিয়ে ধন্য হতেন।
বাবা সিলামপুর হাটে কমণ্ডলু হাতে দোকানে গিয়ে দাঁড়ালেই দোকানদারেরা বাবাকে ভিক্ষা দেওয়ার জন্য বসে থাকতো কেননা তাকে দিলে ধন্য ও পূণ্য হবে ইহা সকলের জানত।
প্রত্যেকেই প্রেম ভরে দিত। সাধুবাবার একটাই কমণ্ডলু ছিল- চাল, ডাল, তরি-তরকারি, মিষ্টি-মিষ্টান্ন যে যা দিত, বাবা ঐ কমন্ডলু তে সবগুলি নিতেন। অনেকে বাবাকে পরীক্ষা করার জন্য কমন্ডলু মুখাপেক্ষা বড় জিনিস দিয়ে আশ্চর্য্য হতো, কেননা তাও অবিলম্বে ঐক্য মন্ডল ওর মুখে ঢুকে যেত, তপঃ প্রভাবের অলৌকিকত্ব।
অসম্ভব বলে কিছু যোগমার্গেনাই।
লীলায় বঙ্কট বাবা দেখাতেন তাই ।।
অনেক সময় শিশু ও বালকরা সাধু বাবা কে বিরক্ত করতো। বালক পিছন থেকে বাবাকে ধাক্কা দিয়ে প্রসাদ পয়সা নিয়ে পালাতে, সদা প্রসন্ন বাবা কাহাকেও কিছু বলতেন না বরং আরও প্রীতি সহ ওদের ডেকে ভালো ভালো প্রসাদ দিতেন। দুষ্টের তাড়ন না করে পোষণ করা ভক্তির অন্যতম লক্ষণ ছিল। অনেক সময় বয়স্ক ব্যক্তিরা দর্শন করে- বলতো, বাবা ছেলেরা আপনাকে এত বিরক্ত করছে অথচ তাদেরকেই ভাল বাসছেন ? উত্তরে বলতেন- যানে দে উন লেড়কে ভি মেরা নাতি পোতা। শিশু আর ভগবানে অভেদ তাই বাবার- বাৎসল্য আচরণ।।
জমিদার হরেকৃষ্ণ চৌধুরীর (বাহাদুরপুর) বাড়িতে বিরাট উৎসব, বহু লোক নিমন্ত্রিত এবং ভোজের আয়োজনও প্রচুর ছিল। বাবার এক ঘোষাল ভক্ত উক্ত নিমন্ত্রিত বাড়িতে দুধ দেবার জন্য বাহু'কে করে দুই ভার দুধ আনছিল, পথমাঝে বাবার মন্দির।
ঘোষ ভাবলো বাবাকে প্রনাম করেই যাবো। এই ভেবে বাবার নিকট ভার রেখে প্রণাম জানাচ্ছে, ইত্যবসরে বাবা হঠাৎ লাঠির আঘাতে দুধের ভার দুইটি ভেঙে দিলেন। অবাক হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, বাবা জমিদারকে আমি কি বলবো? ক্রোধী প্রতাপশালী জমিদার বাবু, কেমন করে তার নিকট প্রাণ বাঁচবে? বাবা উত্তর দিলেন ঘবরাও মাৎ ! জমিদার বাবু কো বললে সে দুধ কা দাম মিল যায়েগা। এইরূপ বাবার কথামতো উক্ত ঘোষ জমিদারের বাড়ি গিয়ে সব কথা বলতেই জমিদার দুধের দাম দিয়ে দিলে কিন্তু এহেন কান্ড দেখে আশ্চর্য হয়ে বাবাকে প্রার্থনা জানালেন। অতঃপর বাবা উত্তর দিলেন, বৃন্দাবন্ মে রাধা রানীজী কে আঁচলে মে আগ লাগা থা, এ দুধ দেকর বুঝা দিয়া! জমিদারবাবু বাবার কথা শুনে আশ্চর্য ও হতবাক হলেন। কতটা সত্য মিথ্যা প্রমাণ নেবার জন্য বাবার নির্দেশ মতো বৃন্দাবনে পত্র দিলে যথাসময়ে উত্তর এলো যে, পত্র মূলের উল্লেখিত দিন তাং ও সময়ে আগুন লাগা সত্য ঘটনা। তবে কেমন করে অগ্নি নির্ব্বাপিত হল তা কেউ জ্ঞাত নই। অবশ্য কোনো ক্ষতি হয়নি। প্রেরিত পত্রের উত্তর জ্ঞাত হয়ে আরও গভীর শ্রদ্ধা ভক্তি প্রত্যেকের চিত্তে জেগে উঠল।
দিব্যদর্শী সিদ্ধ বাক্ সাধক বঙ্কট ।
স্মরণে জীবের কাটে সকল সংকট।।
বাবার অলৌকিক কার্যকলাপের কথা চাচঁল রাজার কর্নে পৌঁছলে, রাজা নিজে হাতিতে চেপে এসে সাধু বাবাকে নিয়ে যাবার জন্য সাধা সাধি করতে লাগলেন। অহংকারী রাজার গর্ব গর্ব করতে সাধুবাবা প্রত্যাখ্যান করে বললেন, শালা হাতি লেকার আয়া? হাম নাহি যায়েঙ্গে! রাজা বহু প্রকারে কাকুতি মিনতি করলেন এবং নিজেও অপুত্র ছিলেন এ-প্রস্তাব আবেগ ভরে জানালে সাধু বাবা বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন, সাধো মাৎ! তুনে এহি শোচা হামারা রাজৈশ্বর্য্য সে সাধু বাবা কো লে যায়েঙ্গে। ক্যা গণেশ বাবা (হাতিকে) হাম্ কো লে যায়ে সাকোগে? হাতি মাথা নেড়ে শুঁড় তুলে বাবাকে প্রনাম জানিয়ে অসম্মতি জানালো। দীর্ঘ হয়ে প্রার্থী না হলে ঐশ্বর্য্যে আহ্বান জয় করা দূরে থাক্ তত্তকেও জয় করা যায়না। যীশু খ্রীষ্টের বাণী :- একটি উট সুঁচের ছিদ্র দিয়ে বেরোতে পারে, কিন্তু অহংকারী ধনী কখনো ঈশ্বরের রাজ্যে প্রবেশ করতে পারে না!
বং কোড বাবা রাজকীয় দম্ভের আহ্বান শ্রবণ করে বললে শালা হাতি লে কর আয়া, দেখনে কে লিয়ে লে আয়া, রানি কা পেট্ মে বাচ্চা ভর দেগা? ভাগ্ ইহাঁসে। অতঃপর নিরাশ হয়ে রাজা ফিরে গেলেন। চাঁচলের রাজা কে লক্ষ্য করে বঙ্কট বাবা জীব শিক্ষা দিয়ে গেছেন। এই দীনতা সম্বন্ধে দু-একটা তুলনা নিম্নে দেওয়া হলো।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আরম্ভের পূর্বে শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করার অভিলাষে দূর্যোধন ও তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন দুজনে দ্বারকায় উপস্থিত হয়ে রাজকীয় দম্ভে দূর্যোধন শিয়রে রত্ন সিংহাসনে বসলেন ও অর্জুন দীনতা নিয়ে পদ সেবায় রত হলেন। শ্রীকৃষ্ণ কপট নিদ্রায় চিৎ হয়ে ঘুমিয়েছিলে, নিদ্রাভঙ্গে প্রথমে অর্জুনের উপর দৃষ্টিপাত হলে, দেখতে পান সেবায় রত। তাই নারায়ণী সেনা দুর্যোধনকে দিয়ে তিনি স্বয়ং পান্ডব পক্ষ অবলম্বন করলেন। উহাতে দুর্যোধনের ধ্বংস ও পান্ডবের জয় হলো (মহাভারত উল্লিখিত)।
নীলাচলে (পুরীক্ষেত্র) মহাপ্রভুকে দর্শনের অভিলাষে উড়িষ্যার রাজা পরম ভক্ত শ্রীপ্রতাপ রুদ্র, মহাপ্রভুর দর্শন পাননি। রাজার পার্ষদ বর্গ মহাপ্রভুকে রাজার অভিলাষের কথা ব্যক্ত করলে মহাপ্রভু উক্তি করলেন, রাজদর্শন সন্ন্যাসীর নয়। রাজা এই খেদোক্তি পরম ভক্ত শ্রীরায় রামানন্দকে জানালেন, রামানন্দ উক্ত কথা মহাপ্রভু কে জানালে তিনি পুনশ্চ একই উক্তি করলেন এবং আরও বললেন, তুমি ওই প্রস্তাব পুনরায় আমাকে জানালে তুমিও আমাকে হারাবে। তখন ওই ভক্তের হৃদয় কম্পিত হলো, তিনি মহাপ্রভুর অসম্মতি কথা রাজাকে জানালে, রাজা অতি দৈন্যতা প্রকাশ করে মহাপ্রভুকে দর্শনের উপায় জানতে চাইলেন। রায় রামানন্দ উপদেশ দিলেন, প্রভু যখন নাম কীর্ত্তনে বিভোর হয়ে ভক্তগণ সঙ্গে বেরোবেন তখন তুমি রাস্তাটা পঞ্চাধ্যায়ের একটি শ্লোক উচ্চৈঃস্বরে গাইবে। রাজা এই উপদেশ মতো উক্ত শ্লোক (যা নিম্নে দেওয়া হলো) গাইতে আরম্ভ করলেন-
শ্লোক শ্রী গোপী গীতা-
তব কথামৃতং তপ্ত জীবনং
কবি ভিরীড়িতং কল্পষাপহম্ ।
শ্রবণ-মঙ্গলং শ্রী মদাততং
ভুবি গৃম্বন্তি যে ভূরিদা জনা ।।
মহাপ্রভুর কর্ণে ঐ নাম প্রবেশ করতেই প্রেমাবেশে মহাপ্রভু দুই হাত প্রসার করে ভক্তকে (রাজাকে) আলিঙ্গন দিয়ে কে তুমি আমার তৃষ্ণার্ত প্রাণে নব প্রাণ সঞ্চার করলে? অতঃপর দৃষ্টিপাত করে রাজাকে দর্শন করে, মহাপ্রভু খেদান্বিত হয়ে বললেন, এ কি বিষয়ী সঙ্গ আমার হল! রাজা দীনতা করে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, প্রভু আপনি না পতিত পাবন, এসেছেন পাপীকে করতে ত্রাণ, বলুন, আপনি উপেক্ষিলে কে নেবে কোলে তুলে? দীনতা বিহনে মিলন বা অভিলাস পূরণ কখনোই সম্ভব নহে, তাই ভগবানের আর এক নাম দীনবন্ধু।
যদ্যপি রাজারে প্রভু দৃঢ় কৃপা কৈল ।
ভক্ত গনে শিক্ষা হেতু ভঙ্গি উঠাইল ।।
ছি ছি বিষয়ীর সঙ্গ হইল আমার ।
নারায়ন নারায়ন একি তিরস্কার ।।
( শ্রী শ্রী ভক্তমাল গ্রন্থ)
সিলামপুরের পার্শ্ববর্তী গ্রামের একটি মুসলমান রেশম কীট্ চাষ করতেন। পোলু পাকার সময় তুঁত পাতার অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধি হলে, উক্ত লোক বাকিতে (কর্জ্জতে) পাতা পেল না। অগত্যা রেশম কীট ফেলতে হবে, আর রেশম কীট ফেলে দিলে তাদেরকে অনাহারে দিন যাপন করতে হবে। তখন লোকটা সাধু বাবার নিকটে এসে খুব কাঁদতে লাগলো। বাবা উহার কারণ জানতে চাইলে তার দুঃখ সাধু বাবাকে খুলে বলল। সাধু বাবা তাকে আশ্বাস দিলেন- রো মাৎ; তালাব সে লোটা পানি লে আ। লোকটি কি জল আনলে উক্ত জলে বাবা সুখ দিয়ে তার হাতে দিয়ে বললেন, যা এ পানি কো তেরা পোলু ঘার মে রাখ দেনা, অউর ধুপ ধুনা জ্বালনা তিস্ পর দড়বাজা বন্ কার রাত কো অন্দর যিত্ না সাকে চান্দার কি লে আনা, যা তেরা দুঃখ্ নেহি রহেগা! উক্ত ব্যক্তি সাধু বাবার কথা মত কাজ করলেন। প্রাতেঃ দরজা খুলে বিস্মিত হলো কারণ, তিনদিন পাতা খাওয়ালে যে পোলু পাকতো, অথচ রাত্রের মধ্যে সমস্ত পোলু পেকেছে! যেটুকু চন্দ্ররকী সংগ্রহ করেছিল তাতে অর্ধেক পোলুও দেওয়া হলো না, তবুও ফলনে চৌদ্দগুণ কোয়া হয়েছিল।
এখনো তার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় প্রতি বন্দে (বছরে চারটি বন্দ)। বাবার মন্দিরে বেদির উপরে ভক্তরা কোয়া দিয়ে ধন্য হচ্ছে।
অনুরাগ এ অনধিকারী প্রাপ্ত করুনা ।
অধিকারী হয়ে ও নষ্ট অনুরাগ বিনা ।।
তাই মুচি হয়ে শুচি, যদি কৃষ্ণ ভজে ।
বিপ্র হয়েও বিপ্র নহে, যদি নাহি পূজে ।।
মহৎ এর কৃপাতে অসম্ভব কিছু নয় ।
অজ্ঞানীও হয় জ্ঞানী গুরু অনুকূল হয় ।।
এ প্রসঙ্গে লক্ষ্য করার বিষয়, কারণ বঞ্চিত কেউ হয়নি। আবেগ ভরে হিন্দু মুসলমান, নর-নারী জ্ঞানী ও গোঁঙার সকলকেই বাবা প্রেম ভরে আলিঙ্গন আপ্যায়ন করেছেন। তিনি অদ্বৈত শিক্ষাগার (অভেদ্ ভাব) রচনা করে গেছেন। আজ পর্য্যন্ত উহা সর্ব্বজন বিদিত, যেহেতু উৎসবে সকলেই যোগদান করে আসছে। মহামানবের এই মিলন ক্ষেত্রে মিলিত হয়ে সকলেই আজ ধন্য।
এই সিলামপুর গ্রামের চার মাইল উত্তরে যুগল তলা গ্রামের বাসিন্দা জগন্নাথ ঘোষ এর মাতা প্রত্যহ বঙ্কট বাবাকে দুধ যোগাতেন। ঝড় বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক যে কোন বিপর্যয় হোক না কেন, দুধ এনে বাবাকে দিয়ে ধন্য হতেন। একদিন ওই বৃদ্ধা মাতা কেঁদে বলল, বাবা আমি কি চির দুঃখিনীহয়েই থাকবো? আমার কি এই দারিদ্রতাঘুচঁবেনা? বঙ্কট বাবা তার সেবায় অতি তৃপ্ত তাই বৃদ্ধাকে দয়া পরবশ হয়ে গুপ্ত লোমাবলীদিয়ে বললেন, যা মায়ি। ইসকোযতন্ সে বাক্সেকে অন্দর রাখ্ দেনা, ধূপ-ধুনা সে পূজা করনা, তেরিদুখ্ দূর হোগা। ওই বৃদ্ধ মাতা পৌত্র ঈশ্বর লালকে সঙ্গে নিয়ে আসতো। উক্ত বালককে লক্ষ্য করে বাবা ভবিষ্যৎ বাণী করলেন, এ লাড়্ কে ভি বহুত বড়াহোগা, লিখা পড়া ভি বহুত যাদাহোগা- উকিল বনেগা, ইন্কাপরমায়াভি বহুত যাদা, যব্ইহাঁ পর অন্নকূটযাগ্হোগা,উতনা দিন তক্ এ লাড়কাবাচেগাঁ।
বাবার আশীর্বাদ ব্যর্থ হয়নি। ক্রমে ক্রমে উক্ত ঘোষ পরিবার ধনে-জনে উন্নত হতে থাকে। কৃপাধন্য শ্রী ঈশ্বর ওকালতি পাস করে মালদহ কোর্টৈ ওকালতি করতেন, তাকে স্বয়ং দেখেছি। অন্নকূটযজ্ঞেরসময় উপস্থিত ছিলাম, তখন ওই কৃপা ধন্য ব্যক্তি সন ১৩৬৭ সাল ইং ১-১-৬১ কুঞ্জ ভঙ্গের পর উক্ত কীর্তন আসরে, (বাবার আমন্ত্রণে উপস্থিত হয়েছিল) বঙ্কট বাবার আচার-আচরণ ও মহত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন। এ স্থান হতে বাড়িগিয়ে কয়েক দিবস পরে ইহলোক ত্যাগ করেন।
এতৎ প্রসঙ্গে উক্ত ঈশ্বর লাল ঘোষ এর পিতার ভাগ্য পরিবর্তন বর্ণনা না করলে বাবার মহিমা সম্পূর্ণ বলা হয়না। তাই বিস্তারিত ভাবে লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য হলাম জগন্নাথ ঘোষ ও তার মায়েরসেবায় বাবা সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, আজ রাতমে জাগকে রেহ্ না। যো দিখেগা, কিসিকোবোলনা মাৎ। উক্ত রাত্রে জগন্নাথ ঘোষ বাবার নির্দেশমতো সারারাত জেগে থাকলে শেষ রাত্রিতে দেখলেন প্রথমে একটি ষাঁড় (বৃষ) এবং তার পশ্চাতে গোরুর পাল (অসংখ্য) চলেই যাচ্ছে যেন শেষ হয়না, সর্বশেষে একটি কৃষ্ণ দীর্ঘকায় পুরুষ লম্বালাঠি কাঁধে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখে জগন্নাথ ঘোষ অবাক হলো পরদিন বাবার নিকটে আসতেই বাবা হাসতে হাসতে বললেন, কেয়া রাত মে কুচ দেখা থা? ঘোষ তাঁর রাত্রের বিবরণ ব্যক্ত করলে, বাবা উক্তি করলেন, যিত্ না দূর ওই গরুকা পাল গিয়াথা, উত্ না দূর তক্তেরাক্ষেতিহোগা। সারকার কে অফিস যা কার নাখরাজ জল কর বান্দবস্ত দেনা। অতঃপর জগন্নাথ ঘোষ বাবার কথামত কাজ করে বিস্তর জমি লাভ করে ধনবান ও ঐশ্বর্যবান হয়েছে। বাবার সেই কৃপা ধন্য পরিবারের পুত্রবধূশ্রীমতি সুভদ্রা যাদব কর্তৃক বাবার মন্দির নির্মিত হয়েছে। উক্ত মন্দির প্রাঙ্গণে প্রতিবছর আনন্দ কোলাহল ও মুখরিতার মধ্য দিয়ে বাবার উৎসব এখনো চলছেই।
বঙ্কট বাবা বলেছেন কালিয়াচক শহর বনেগা! বাবার কথা স্বতঃসিদ্ধ পূর্বে যে কালিয়াচক বনজঙ্গলে পূর্ণ ছিল, তা সর্বজন বিদিত। আজ উক্ত কালিয়াচক বর্ণনা করা কল্পনাতীত।
কালিয়াচকে হাইস্কুল, হাসপাতাল, ব্লক অফিস, জে এল আর অফিস, ইলেকট্রিক অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস, ব্যাংক, ট্রান্সপোর্ট, সিনেমা হল ও বিভিন্ন দোকান অবস্থিত। (ইহা একটি বিরাট বাণিজ্য কেন্দ্র)
বাবা আরো বলেছেন, গঙ্গা মাই হামকোলেযায়েগি! একথাও ব্যর্থ হয়নি। ১৯৭১ সালে বন্যা স্ফিতি হয়ে বাবার সমাধি স্পর্শ করে, সুনিশ্চিত ভাবে তার সন্তানকে নিশ্চয়ই তার কাছে নিয়ে গেছেন।
এখানে রয়েছে তার স্মৃতি, রয়েছে তার তপঃ সিদ্ধ ও অলৌকিক পূর্ণময় আলো, যা যুগ যুগ ধরে দূর-দূরান্ত থেকে অগণিত ভক্তকে এই পুণ্যভূমিতে আকর্ষণ করে আনছে।
বঙ্কট বাবার বহু কার্যকলাপ জানার অভাবে অলিখিত হয়ে রইল। বহু লীলা করে বহু জনকে কৃপা করে এবং বহু ভক্ত সৃষ্টি করে বঙ্কট বাবা শেষ দিন পর্যন্ত এই সিলামপুর বিরাজ করেছেন। তারপর ১৩০৪ সালে ৯ই পৌষ বাবার মহা বিজয় দিবস।
৮ই পৌষ সন্ধ্যার পর বহু ভক্তের সমাগম হলে, বাবা সম্বন্ধন ও আপ্যায়ন করে তার দেহ রক্ষার কিঞ্চিত ইঙ্গিত জানালেন ও পরদিন ৯ই পৌষ পূর্ব আকাশে রক্তিম আবির মাখা বর্ণে ঊষারাণী উদিত হওয়ার প্রাক্কালে বাবা প্রাতঃক্রিয়া সম্পন্ন করে শুভলগ্নে দেহ রক্ষা করলেন।
বাবার বাহ্যিক জীবন দীপ নিভলেও তার কর্ম্মের ও করুণার দীপ রক্তিম দিবাকরের মত তিমিরাচ্ছন্ন ভুবনে প্রজ্জ্বলিত হয়ে চিরতরেদীপ্তিসনে হয়ে রইলো। যার অনির্বাণ লেলিহান শিখা যুগ যুগ ধরে নরাধমদের কল্যাণের মুক্তির পথ প্রশস্ত করে মোক্ষলাভেরসোপানগুলিতে নিয়ে যাবে। কিন্তু শ্রদ্ধেয় ও পূজনীয় বঙ্কট বাবার অলক্ষ্যে হারাবার বাণী শ্রবনেই, ভক্তগণ বিরহে ব্যতীত হলো। শুরু হলো আর্তকন্ঠে কীর্তন। দেহরক্ষা কালীন বাবার এক কৌতুক ময় লীলা রহস্যেরও সাক্ষী ছিলো সিলামপুর ভূমি। সিলামপুর ভূমিতে মৃতাত্মাপড়ে আছে সূক্ষ্ম ও নিষ্প্রাণ দেহে, আবার তিনি স্থূল দেহের খেজুরিয়া ঘাটে গোলাম মহালদার নামক এক মুসলমান ভক্তকে দর্শনদিয়ে মুক্ত করলেন। উক্ত মহালদারধুলিয়ান থেকে বাড়ি ফেরার পথে নৌকা থেকে নামতেই সাধু বাবা কে অন্য নৌকায়চাপ্তের দেখে জিজ্ঞেস করল, বাবা আপ্কাহাঁ যা রাহে হো?
বাবা- উত্তর দিলেন, কিসিকো মাৎ বোলনা হাম বৃন্দাবন চল্ রাহা। এবাতকিসিকোবোলনেসেখত্ রা হোগা। অতঃপর বাবা চলে গেলেন। উক্ত মহালদারবাড়ি ফেরার পথে সিলামপুর গ্রামে বহু লোকের জমায়েত দেখে জিজ্ঞাসা করল, এখানে এত ভিড় কেন? লোকে বলল, তুমি জাননা সাধু বাবা দেহ রেখেছেন। এ কথা শ্রবণেইমহালদার অবাক হলো, বাবার স্থূল দেহের কথা ভাবতে ভাবতে......আনমনা হয়ে, সেকি বাবা আমাকে খেজুরিয়া ঘাটে বললেন, হাম বৃন্দাবন চাল রাহা হু...... অতঃপর এমতাবস্থায়মহালদার বাবার বৃন্দাবন গমনের কথা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করলে, ভক্তরা আশ্চর্য হয়ে বলল ধন্য তুমি বাবার দর্শন পেলে। উক্ত বার্তাবাহী এই বাক্যালাপ করে বাড়ি গেল এবং বাবার কথা অমান্য করায় ওই রাত্রেই তার মৃত্যু হল।
যোগসিদ্ধ যিনি মহাপুরুষ নামে আখ্যা ।
সু-গন্ধে সু-অনুলেপন, সবে করে ব্যাখ্যা ।।
এরামরেনা, স্হূলদেহত্যাজী হয় অদেখা ।
ভক্ত চিত্তে বসবাস, যে অন্তরঙ্গ সখা ।।
এ-হেন পর্যায়ে, যে জন উত্তীর্ণ পরীক্ষা । আজ ও প্রকট ঐ মহৎ "আর্ত্ত" মাগে ভিক্ষা ।।
বঙ্কট বাবার অন্তর্ধান এর পর ভক্তদের মনে চিন্তা হলো বাবাকে কোথায় সমাধি দেওয়াযায়। বহু আলাপ-আলোচনায় স্থির হল, পাগলা নদী কূলে সমাধি দেওয়া হবে। এহেন সময়দু'জন মুসলমান ভক্ত আকবর আলী মিঞা ও বাবর আলী মিঞা উপস্থিত হয়ে, পাগলা নদী কূলে বাবার সমাধি হবে জেনে বলল, আমাদের জমিদারের মাটিতে বাবার সমাধি দাও কারণ তোমাদের যে শ্রদ্ধার পাত্র ছিল, তা তোমাদের সেবার উপযোগী হয়ে থাক্। আমাদের যেমন পীর, তোমাদের তেমন সন্ন্যাসী। বস্তুতঃ তারা ভাবে- এ এক। শুধু দেখতে পৃথক। উক্ত দু'জন জমিদার বংশের সন্তান এবং তারা ধার্মিকও বটে। যাই হোক ভক্তদের ভাবানুযায়ী ভগবান ব্যক্ত। একথানুতন নয়, শাস্ত্র সম্মত। সিলামপুর হাট প্রাঙ্গণেজমিদারির মাটিতে পূর্ব দিকের এক কোণে শিব লিঙ্গাকারে রাখাল চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এর নেতৃত্বে বাংলার ১৩০৪ সালে ৯ই পৌষ বাবার সমাধি স্থাপিত হয়।
আজও সেই সমাধি বিরাজ করছে। বর্তমানে উক্ত সমাধির উপর মন্দির নির্মিত হয়েছে। প্রতিবছর এই সমাধি দর্শনের জন্য দেশ বিদেশ থেকে অগণিত ভক্ত বৃন্দ নিজ নিজ কামনা বাসনা নিয়ে আসে এবং দুধ, ফল, গাঁজা ও বিভিন্ন প্রকার মিষ্টান্ন, ছানা, মাখন ইত্যাদি দিয়ে ধন্য হয়ে থাকে।
বিশ্ব মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হে বাবা বঙ্কট ।
তব নামে কেটে যায় সকল সংকট ।।
হে তাপস; সবার প্রিয় ভক্তের নয়নপট্ ।
সীতাদেবীর আশীর্বাদে যেমন অক্ষয় বট ।।
বাংলা সন ১৩০৫ সাল হতে গ্রামের ভক্তবৃন্দরা একত্রে মিলিত হয়ে বাবার দেহরক্ষাদিবসটিতে (৯ই পৌষ) স্মৃতি উদযাপন আরম্ভ করলো। যার যেমন সামর্থ্য অনুযায়ী চাল, ডাল, টাকা-পয়সা ইত্যাদি দান করে উক্ত সামগ্রী ব্রাহ্মণ দ্বারা অন্নভোগ প্রস্তুত করত; বাবার উদ্দেশ্যে ওই স্মৃতি সৌধ- এ বা সমাধি ক্ষেত্রে নিবেদন ও ভোগ আরতি কীর্তন করে প্রসাদ বিতরণ করত। সেই দিনটি আমাদের নিকট আজও অতি পবিত্র ও পরম আনন্দদায়ক।
সে দিন এই উৎসবপরিচালনায় শ্রী রাখাল চন্দ্র বন্দোপাধ্যায় নিযুক্ত ছিলেন। কয়েক বছর ওই ভাবে চলতে থাকে। তারপর ১৩৩৫ সালে কমিটি গঠিত হলে প্রহর পদ্ধতি যজ্ঞারম্ভ হয়। বর্তমানে আমরা শুধু গ্রামবাসী নয়, বিভিন্ন গ্রামের ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেরা মিলনের সূত্রে বদ্ধ হয়ে এবং সকলের মিলিত ও যৌথ প্রচেষ্টায়- বিরাট আকারে নর-নারায়ন সেবা সহ বাবার উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডেপড়েওঅদগ্ধ থাকা ।।
গ্রামে দলাদলির ফলে, বিরোধী দলেরা চক্রান্ত করে বাবার উৎসবেরপাচঁক ব্রাহ্মণ শ্রী ঋষিকেশরায় কে (মেহেরপুর) আটক করে রাখে। উৎসব দিবসে উক্ত গ্রাম মনের আসতে দেরি দেখে গ্রামবাসীরাচিন্তান্বিত হলো। ওদিকে ব্রাহ্মণ বেকায়দায়পড়ে অতঃপর বাবাকে ফোন করে বলল, তুমি যা করার করো, আমার যজমান থাক বা না থাক তোমার কাজে যাবো। খানিক পরে সে বেরিয়ে পড়লো। এইখানে অসময় এসে উপস্থিত হলে পরিচালক রাখালবাবু তাকে ভর্ৎসনা করলে ব্রাহ্মণ সত্যমিথ্যা নানা কথা বলে কাজে লাগলো। সেই সময়ে লম্বা করে চুল্লি তৈরি করে একটি উনুনেই পাশাপাশি চারটি হাঁড়ি চাপানো হত। রন্ধন প্রস্তুত করে হাঁড়ি নামাতে লাগল ১ম, ২য়, ৩য় হাঁড়িনামিয়ে ৪র্থ নামাতে আকস্মাৎ কে যেন ব্রাহ্মণকে উক্ত চুল্লীতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। এই দৃশ্য দেখে সকলে ব্যস্ত হয়ে বাবার জয়ধ্বনি ও হরিধ্বনি দিতে দিতেই সে অবিলম্বে উঠে দাঁড়ালে সকলে আশ্চর্য হয়ে, লক্ষ্য করলো তার দেহের কোন অংশে আচঁ লাগে নাই।
এই সিলামপুর গ্রামের চার মাইল উত্তরে যুগল তলা গ্রামের বাসিন্দা জগন্নাথ ঘোষ এর মাতা প্রত্যহ বঙ্কট বাবাকে দুধ যোগাতেন। ঝড় বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক যে কোন বিপর্যয় হোক না কেন, দুধ এনে বাবাকে দিয়ে ধন্য হতেন। একদিন ওই বৃদ্ধা মাতা কেঁদে বলল, বাবা আমি কি চির দুঃখিনী হয়েই থাকবো? আমার কি এই দারিদ্রতা ঘুচঁবেনা? বঙ্কট বাবা তার সেবায় অতি তৃপ্ত তাই বৃদ্ধাকে দয়া পরবশ হয়ে গুপ্ত লোমাবলী দিয়ে বললেন, যা মায়ি। ইসকো যতন্ সে বাক্সেকে অন্দর রাখ্ দেনা, ধূপ-ধুনা সে পূজা করনা, তেরি দুখ্ দূর হোগা। ওই বৃদ্ধ মাতা পৌত্র ঈশ্বর লালকে সঙ্গে নিয়ে আসতো। উক্ত বালককে লক্ষ্য করে বাবা ভবিষ্যৎ বাণী করলেন, এ লাড়্ কে ভি বহুত বড়া হোগা, লিখা পড়া ভি বহুত যাদা হোগা- উকিল বনেগা, ইন্ কা পরমায়া ভি বহুত যাদা, যব্ ইহাঁ পর অন্নকূট যাগ্ হোগা,উতনা দিন তক্ এ লাড়কা বাচেগাঁ।
বাবার আশীর্বাদ ব্যর্থ হয়নি। ক্রমে ক্রমে উক্ত ঘোষ পরিবার ধনে-জনে উন্নত হতে থাকে। কৃপাধন্য শ্রী ঈশ্বর ওকালতি পাস করে মালদহ কোর্টৈ ওকালতি করতেন, তাকে স্বয়ং দেখেছি। অন্নকূট যজ্ঞের সময় উপস্থিত ছিলাম, তখন ওই কৃপা ধন্য ব্যক্তি সন ১৩৬৭ সাল ইং ১-১-৬১ কুঞ্জ ভঙ্গের পর উক্ত কীর্তন আসরে, (বাবার আমন্ত্রণে উপস্থিত হয়েছিল) বঙ্কট বাবার আচার-আচরণ ও মহত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন। এ স্থান হতে বাড়ি গিয়ে কয়েক দিবস পরে ইহলোক ত্যাগ করেন।
এতৎ প্রসঙ্গে উক্ত ঈশ্বর লাল ঘোষ এর পিতার ভাগ্য পরিবর্তন বর্ণনা না করলে বাবার মহিমা সম্পূর্ণ বলা হয়না। তাই বিস্তারিত ভাবে লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য হলাম জগন্নাথ ঘোষ ও তার মায়ের সেবায় বাবা সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, আজ রাতমে জাগকে রেহ্ না। যো দিখেগা, কিসিকো বোলনা মাৎ। উক্ত রাত্রে জগন্নাথ ঘোষ বাবার নির্দেশমতো সারারাত জেগে থাকলে শেষ রাত্রিতে দেখলেন প্রথমে একটি ষাঁড় (বৃষ) এবং তার পশ্চাতে গোরুর পাল (অসংখ্য) চলেই যাচ্ছে যেন শেষ হয়না, সর্বশেষে একটি কৃষ্ণ দীর্ঘকায় পুরুষ লম্বালাঠি কাঁধে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখে জগন্নাথ ঘোষ অবাক হলো পরদিন বাবার নিকটে আসতেই বাবা হাসতে হাসতে বললেন, কেয়া রাত মে কুচ দেখা থা? ঘোষ তাঁর রাত্রের বিবরণ ব্যক্ত করলে, বাবা উক্তি করলেন, যিত্ না দূর ওই গরুকা পাল গিয়া থা, উত্ না দূর তক্ তেরা ক্ষেতি হোগা। সারকার কে অফিস যা কার নাখরাজ জল কর বান্দবস্ত দেনা। অতঃপর জগন্নাথ ঘোষ বাবার কথামত কাজ করে বিস্তর জমি লাভ করে ধনবান ও ঐশ্বর্যবান হয়েছে। বাবার সেই কৃপা ধন্য পরিবারের পুত্রবধূ শ্রীমতি সুভদ্রা যাদব কর্তৃক বাবার মন্দির নির্মিত হয়েছে। উক্ত মন্দির প্রাঙ্গণে প্রতিবছর আনন্দ কোলাহল ও মুখরিতার মধ্য দিয়ে বাবার উৎসব এখনো চলছেই।
বঙ্কট বাবা বলেছেন কালিয়াচক শহর বনেগা! বাবার কথা স্বতঃসিদ্ধ পূর্বে যে কালিয়াচক বনজঙ্গলে পূর্ণ ছিল, তা সর্বজন বিদিত। আজ উক্ত কালিয়াচক বর্ণনা করা কল্পনাতীত।
কালিয়াচকে হাইস্কুল, হাসপাতাল, ব্লক অফিস, জে এল আর অফিস, ইলেকট্রিক অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস, ব্যাংক, ট্রান্সপোর্ট, সিনেমা হল ও বিভিন্ন দোকান অবস্থিত। (ইহা একটি বিরাট বাণিজ্য কেন্দ্র)
বাবা আরো বলেছেন, গঙ্গা মাই হামকো লে যায়েগি! একথাও ব্যর্থ হয়নি। ১৯৭১ সালে বন্যা স্ফিতি হয়ে বাবার সমাধি স্পর্শ করে, সুনিশ্চিত ভাবে তার সন্তানকে নিশ্চয়ই তার কাছে নিয়ে গেছেন।
এখানে রয়েছে তার স্মৃতি, রয়েছে তার তপঃ সিদ্ধ ও অলৌকিক পূর্ণময় আলো, যা যুগ যুগ ধরে দূর-দূরান্ত থেকে অগণিত ভক্তকে এই পুণ্যভূমিতে আকর্ষণ করে আনছে।
বঙ্কট বাবার বহু কার্যকলাপ জানার অভাবে অলিখিত হয়ে রইল। বহু লীলা করে বহু জনকে কৃপা করে এবং বহু ভক্ত সৃষ্টি করে বঙ্কট বাবা শেষ দিন পর্যন্ত এই সিলামপুর বিরাজ করেছেন। তারপর ১৩০৪ সালে ৯ই পৌষ বাবার মহা বিজয় দিবস।
৮ই পৌষ সন্ধ্যার পর বহু ভক্তের সমাগম হলে, বাবা সম্বন্ধন ও আপ্যায়ন করে তার দেহ রক্ষার কিঞ্চিত ইঙ্গিত জানালেন ও পরদিন ৯ই পৌষ পূর্ব আকাশে রক্তিম আবির মাখা বর্ণে ঊষারাণী উদিত হওয়ার প্রাক্কালে বাবা প্রাতঃক্রিয়া সম্পন্ন করে শুভলগ্নে দেহ রক্ষা করলেন।
বাবার বাহ্যিক জীবন দীপ নিভলেও তার কর্ম্মের ও করুণার দীপ রক্তিম দিবাকরের মত তিমিরাচ্ছন্ন ভুবনে প্রজ্জ্বলিত হয়ে চিরতরে দীপ্তিসনে হয়ে রইলো। যার অনির্বাণ লেলিহান শিখা যুগ যুগ ধরে নরাধমদের কল্যাণের মুক্তির পথ প্রশস্ত করে মোক্ষলাভের সোপানগুলিতে নিয়ে যাবে। কিন্তু শ্রদ্ধেয় ও পূজনীয় বঙ্কট বাবার অলক্ষ্যে হারাবার বাণী শ্রবনেই, ভক্তগণ বিরহে ব্যতীত হলো। শুরু হলো আর্তকন্ঠে কীর্তন। দেহরক্ষা কালীন বাবার এক কৌতুক ময় লীলা রহস্যেরও সাক্ষী ছিলো সিলামপুর ভূমি। সিলামপুর ভূমিতে মৃতাত্মা পড়ে আছে সূক্ষ্ম ও নিষ্প্রাণ দেহে, আবার তিনি স্থূল দেহের খেজুরিয়া ঘাটে গোলাম মহালদার নামক এক মুসলমান ভক্তকে দর্শন দিয়ে মুক্ত করলেন। উক্ত মহালদার ধুলিয়ান থেকে বাড়ি ফেরার পথে নৌকা থেকে নামতেই সাধু বাবা কে অন্য নৌকায় চাপ্তের দেখে জিজ্ঞেস করল, বাবা আপ্ কাহাঁ যা রাহে হো?
বাবা- উত্তর দিলেন, কিসিকো মাৎ বোলনা হাম বৃন্দাবন চল্ রাহা। এবাত কিসিকো বোলনেসে খত্ রা হোগা। অতঃপর বাবা চলে গেলেন। উক্ত মহালদার বাড়ি ফেরার পথে সিলামপুর গ্রামে বহু লোকের জমায়েত দেখে জিজ্ঞাসা করল, এখানে এত ভিড় কেন? লোকে বলল, তুমি জাননা সাধু বাবা দেহ রেখেছেন। এ কথা শ্রবণেই মহালদার অবাক হলো, বাবার স্থূল দেহের কথা ভাবতে ভাবতে......আনমনা হয়ে, সেকি বাবা আমাকে খেজুরিয়া ঘাটে বললেন, হাম বৃন্দাবন চাল রাহা হু...... অতঃপর এমতাবস্থায় মহালদার বাবার বৃন্দাবন গমনের কথা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করলে, ভক্তরা আশ্চর্য হয়ে বলল ধন্য তুমি বাবার দর্শন পেলে। উক্ত বার্তাবাহী এই বাক্যালাপ করে বাড়ি গেল এবং বাবার কথা অমান্য করায় ওই রাত্রেই তার মৃত্যু হল।
যোগসিদ্ধ যিনি মহাপুরুষ নামে আখ্যা ।
সু-গন্ধে সু-অনুলেপন, সবে করে ব্যাখ্যা ।।
এরা মরেনা, স্হূলদেহ ত্যাজী হয় অদেখা ।
ভক্ত চিত্তে বসবাস, যে অন্তরঙ্গ সখা ।।
এ-হেন পর্যায়ে, যে জন উত্তীর্ণ পরীক্ষা । আজ ও প্রকট ঐ মহৎ "আর্ত্ত" মাগে ভিক্ষা ।।
বঙ্কট বাবার অন্তর্ধান এর পর ভক্তদের মনে চিন্তা হলো বাবাকে কোথায় সমাধি দেওয়া যায়। বহু আলাপ-আলোচনায় স্থির হল, পাগলা নদী কূলে সমাধি দেওয়া হবে। এহেন সময় দু'জন মুসলমান ভক্ত আকবর আলী মিঞা ও বাবর আলী মিঞা উপস্থিত হয়ে, পাগলা নদী কূলে বাবার সমাধি হবে জেনে বলল, আমাদের জমিদারের মাটিতে বাবার সমাধি দাও কারণ তোমাদের যে শ্রদ্ধার পাত্র ছিল, তা তোমাদের সেবার উপযোগী হয়ে থাক্। আমাদের যেমন পীর, তোমাদের তেমন সন্ন্যাসী। বস্তুতঃ তারা ভাবে- এ এক। শুধু দেখতে পৃথক। উক্ত দু'জন জমিদার বংশের সন্তান এবং তারা ধার্মিকও বটে। যাই হোক ভক্তদের ভাবানুযায়ী ভগবান ব্যক্ত। একথা নুতন নয়, শাস্ত্র সম্মত। সিলামপুর হাট প্রাঙ্গণে জমিদারির মাটিতে পূর্ব দিকের এক কোণে শিব লিঙ্গাকারে রাখাল চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এর নেতৃত্বে বাংলার ১৩০৪ সালে ৯ই পৌষ বাবার সমাধি স্থাপিত হয়।
আজও সেই সমাধি বিরাজ করছে। বর্তমানে উক্ত সমাধির উপর মন্দির নির্মিত হয়েছে। প্রতিবছর এই সমাধি দর্শনের জন্য দেশ বিদেশ থেকে অগণিত ভক্ত বৃন্দ নিজ নিজ কামনা বাসনা নিয়ে আসে এবং দুধ, ফল, গাঁজা ও বিভিন্ন প্রকার মিষ্টান্ন, ছানা, মাখন ইত্যাদি দিয়ে ধন্য হয়ে থাকে।
বিশ্ব মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হে বাবা বঙ্কট ।
তব নামে কেটে যায় সকল সংকট ।।
হে তাপস; সবার প্রিয় ভক্তের নয়ন পট্ ।
সীতাদেবীর আশীর্বাদে যেমন অক্ষয় বট ।।
দক্ষিণ হতে আগমন-
উত্তরে অবস্থান ।
মৃত দেহ পূর্ব্বে পতিত,
পশ্চিমে অন্তর্ধান ।।
বাংলা সন ১৩০৫ সাল হতে গ্রামের ভক্তবৃন্দরা একত্রে মিলিত হয়ে বাবার দেহরক্ষা দিবসটিতে (৯ই পৌষ) স্মৃতি উদযাপন আরম্ভ করলো। যার যেমন সামর্থ্য অনুযায়ী চাল, ডাল, টাকা-পয়সা ইত্যাদি দান করে উক্ত সামগ্রী ব্রাহ্মণ দ্বারা অন্নভোগ প্রস্তুত করত; বাবার উদ্দেশ্যে ওই স্মৃতি সৌধ- এ বা সমাধি ক্ষেত্রে নিবেদন ও ভোগ আরতি কীর্তন করে প্রসাদ বিতরণ করত। সেই দিনটি আমাদের নিকট আজও অতি পবিত্র ও পরম আনন্দদায়ক।
সে দিন এই উৎসব পরিচালনায় শ্রী রাখাল চন্দ্র বন্দোপাধ্যায় নিযুক্ত ছিলেন। কয়েক বছর ওই ভাবে চলতে থাকে। তারপর ১৩৩৫ সালে কমিটি গঠিত হলে প্রহর পদ্ধতি যজ্ঞারম্ভ হয়। বর্তমানে আমরা শুধু গ্রামবাসী নয়, বিভিন্ন গ্রামের ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেরা মিলনের সূত্রে বদ্ধ হয়ে এবং সকলের মিলিত ও যৌথ প্রচেষ্টায়- বিরাট আকারে নর-নারায়ন সেবা সহ বাবার উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
গ্রামে দলাদলির ফলে, বিরোধী দলেরা চক্রান্ত করে বাবার উৎসবের পাচঁক ব্রাহ্মণ শ্রী ঋষিকেশ রায় কে (মেহেরপুর) আটক করে রাখে। উৎসব দিবসে উক্ত গ্রাম মনের আসতে দেরি দেখে গ্রামবাসীরা চিন্তান্বিত হলো। ওদিকে ব্রাহ্মণ বেকায়দায় পড়ে অতঃপর বাবাকে ফোন করে বলল, তুমি যা করার করো, আমার যজমান থাক বা না থাক তোমার কাজে যাবো। খানিক পরে সে বেরিয়ে পড়লো। এইখানে অসময় এসে উপস্থিত হলে পরিচালক রাখালবাবু তাকে ভর্ৎসনা করলে ব্রাহ্মণ সত্যমিথ্যা নানা কথা বলে কাজে লাগলো। সেই সময়ে লম্বা করে চুল্লি তৈরি করে একটি উনুনেই পাশাপাশি চারটি হাঁড়ি চাপানো হত। রন্ধন প্রস্তুত করে হাঁড়ি নামাতে লাগল ১ম, ২য়, ৩য় হাঁড়ি নামিয়ে ৪র্থ নামাতে আকস্মাৎ কে যেন ব্রাহ্মণকে উক্ত চুল্লীতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। এই দৃশ্য দেখে সকলে ব্যস্ত হয়ে বাবার জয়ধ্বনি ও হরিধ্বনি দিতে দিতেই সে অবিলম্বে উঠে দাঁড়ালে সকলে আশ্চর্য হয়ে, লক্ষ্য করলো তার দেহের কোন অংশে আচঁ লাগে নাই।
উৎসব দিবসে (৯ই পৌষ) সকলে মহানন্দে বাবার কর্মের আয়োজনে ব্যস্ত আছে কিন্তু বাবার সমাধি সংলগ্ন শ্রী উমেশ চন্দ্র সাহা প্রত্যেকের নিষেধ অমান্য করে গুড় নিয়ে মেঘা হাটে রওনা হল। গুড় বোঝাই গরুর গাড়ি পূর্ব দিন (সন্ধ্যায়) পাঠিয়েছিল, হাটে গিয়ে গাড়ি না দেখে হতাশ হয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পর কোন সন্ধান না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এলো। খুব গরীব মানুষ আবার কর্জ্জ নিয়ে ব্যবসা করেছিল, সর্বস্বান্ত হয়ে কেঁদে বেড়াতে লাগল। অনেকেই তাকে দেখে ভর্ৎসনার ছলে বহু কথা বলে ধিক্কার দিল, আবার অনেকে দুঃখিত হয়ে বাবার উৎসবের অবহেলার প্রতিফল স্বরূপ চিন্তা করে তাকে বলল, বাবাকে আরাধনা কর, তাঁর দয়া হলে তুমি মুক্তি পাবে, ব্যাথাতুর উমেশ সাহা বাবাকে প্রনাম করে তার অপরাধের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হলো। তাতেই কৃপাসিন্ধু বাবার দয়া উপজিল। তিন দিন পর গুড় বোঝাই গরুর গাড়ি ঘরে ফিরে এলো। তারপর গাড়ুয়ান ছল ছল নেত্রে বললো, কে যেন আমাকে ভুল করায়ে বিপথে নিয়ে গিয়েছিল, দু'দিন দু'রাত কতদূর পথ চলার পর আমার চৈতন্য ফিরলো। আশ্চর্য উমেশ সাহার কোন আর্থিক ক্ষতি হয়নি। শুধু হয়রানি লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা যেটুকু তার প্রাপ্য ছিল সেটুকু পেয়েছিল। বাবা তার অহংকার চূর্ণ করে অবোধের শিক্ষা দিয়েছে দেহ নিয়ে না থাকলেও সত্ত্ব-সম্পন্ন বাবার সর্বদা প্রকট রয়েছেন।
আজও বিরাজমান, অ-নাথ, এর,
অনুমান ।
লভেছে যে দিব্যজ্ঞান,
প্রাপ্য তার দর্শন ।।
(আমার স্বয়ং দর্শন)
আমি ও শ্রী মহেশ চন্দ্র পাল দুজন ভগবানপুর গ্রামে চাঁদা আদায়ের নিমিত্তে গমন করি। গন্তব্যে পৌঁছতে মাত্র ১ মাইল বাকি, পথ মধ্যে হঠাৎ আমার সঙ্গীটির পায়ে ব্যথা আরম্ভ হল। কোনও প্রকারে অতিকষ্টে উক্ত গ্রামে পৌঁছালাম ( শ্রীডোমন চন্দ্র সাহার পিসিমা পাগলীর বাড়িতে উঠলাম)।
অতিশয় ব্যথা ও যন্ত্রণায় সঙ্গীটি কাঁদতে আরম্ভ করলে উক্ত পাগলী মা বঙ্কট বাবার সম্বন্ধে তার বহু কথা ব্যক্ত করে আশ্বাস দিয়ে বলল, দূর পাগল! তোরা বাবার কাজ করতে এসে বিপদে পড়ে কাঁদছিস? শীঘ্র তোরা বাবার নাম কর্, বাবার অসীম শক্তি; তোরা জানিস না? আমি চোখের সামনে কত কি লীলা মাহাত্ম্য দর্শন করেছি! কত বিপদাপন্ন ব্যক্তি উদ্ধার হয়েছে! তোরাও তার নাম করলে মুক্ত হবি। তারপর সঙ্গীটি বঙ্কট বাবাকে স্মরণ করতে করতেই না খেয়ে শয়ন করলো। খানিক পরে দেখলাম সঙ্গীটি দিব্যি ঘুমাচ্ছে। তখন আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমালাম। পরদিন সকালে নিদ্রাভঙ্গের পর তার পা স্বাভাবিক ও সুস্থ হয়েছে দেখে আশ্চর্য হলাম। তার পায়ে বিন্দুমাত্র ফুলা বা ব্যথা নেই। অতঃপর সানন্দে বাবার উৎসবের চাঁদা আদায় করে উভয়ে বাড়ি ফিরে আসলাম।
হে সঙ্কট মোচন বাবা বঙ্কট
তোমায় কে জানে ।
হয়েছ চক্ষুরান্তরাল বটে! তবু
আছ বিদ্যমানে ।।
উক্ত ভক্ত শ্রী মহেশ চন্দ্র পাল অকালে সন ১৩৮৫ সালে পরলোকগমন করেছেন।
বঙ্কট বাবার কৃপাধন্য পরিবারের ঘোষ বংশধর শ্রী দেবেশ প্রসাদ যাদবের পিতৃশ্রাদ্ধে বহু নিমন্ত্রিত আত্মীয়-স্বজন সেবায় বসেছে, এমতাবস্থায় কয়েকজন চক্রান্ত করে দেবেশ বাবুকে অপমান করার চেষ্টায় মিষ্টি আলাপ করছে যা চিন্তা করা কল্পনাতীত, আয়োজন প্রচুর থাকা সত্ত্বেও ভান্ডারী ভান্ডার হালকা লক্ষ্য করে গৃহস্বামী কে জানালে, কি আর করে অগত্যা স্বামী স্ত্রী দুজনেই যুক্তি করে স্থির করলো যার কৃপাধন্য পেয়ে আমরা আজ সুখী হতে পেরেছি চলো তার ধ্যান করি। রাখে হরি, মারে কে? এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ছাদে গিয়ে বাবার সমাধিক্ষেত্র লক্ষ করে ধ্যানাবিষ্ট হলো।
ইত্যবসরে করুণাঘন বাবার কৃপা যে, একটি ঘোষ ছানা বিক্রি করতে কালিয়াচক আসতো কিন্তু সেদিন তার মনে হলো আজ বাবুর বাড়ি হোলি কালিয়াচক যাবো, যদি বাবুর ছানার দরকার হয়! ঈশ্বরের করুণা ভক্ত ব্যতীত চায়না তাই ঘোষ দ্বারে এসে উপস্থিত হলো। গৃহস্বামীকে সংবাদ দিলে আনন্দচিত্তে ঐ ছানা ক্রয় করে বিপদ থেকে মুক্তি হলো।
কাতর স্বরে ভক্তের উক্তিঃ-
অন্তর্যামী ওগো দয়াল হয়ে সদয় ।
রক্ষীলে ভক্তের মান, বঙ্কট দয়াময় ।।
সেবক বাৎসল্য তুমি অনুকূল হলে ।
বিপদে বাঁচাও তারে তুমি কৃপাবলে ।।
অফুরন্ত দয়া সাধনে, করেছো সংগ্রহ ।
তাই, সংকট ত্রাণ, তবানু গ্ৰহ ।।
(শ্রী নরেন্দ্র নাথ সাহার উক্তি)
সারা বছর ধরে......
বঙ্কট বাবার উৎসবের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা ও সভা চলতে থাকে। এইটি আমাদের বৈশিষ্ট্য গৌরবেরই বিষয়। একদিন বিশেষ করে এই আলোচনায় মুষ্টিমেয় ভক্ত সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে প্রস্তাব উঠলো, আমরা সারাদিন কর্ম্মের পর সন্ধ্যায় অবসরপ্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন প্রকারের বৃথা সময় নষ্ট না করে, যদি ওই সময়টা আমরা একতাবদ্ধ হয়ে ভগবৎ প্রসঙ্গ নিয়ে থাকলে ভাল নয় কি? এ কথায় অনেকেই সম্মত হলে পরদিবস থেকে আলোচনা কেন্দ্রের সূত্রপাত হলো।সন্ধ্যা বন্দনা, ধর্মগ্রন্থাধ্যায়, হরিনাম সংকীর্তন, আরম্ভ হলে, ক্রমে ক্রমে আলোচনা জমতে থাকলো। ভাবনাময়ের ভাবে, প্রত্যেকের মনেই সৎ ভাব্ এর সৃষ্টি হতে লাগল। ভগবানের নামে যুক্ত থাকলে তারঁ কৃপা অলক্ষ্যে প্রাপ্ত হয় একথা নতুন নহে ইহা শাস্ত্র সম্মত। এক রাত্রে শ্রী ক্ষুদিরাম সাহা বঙ্কট বাবার অনুভূতি ও স্বপ্নে চাক্ষুষ দর্শণ করল যে বাবার সমাধি প্রাঙ্গণে একশত এক মন আতপ অন্ন রাশিকৃত হয়েছে, ওই স্থানে গিরী গোবর্দ্ধন মূর্তি স্থাপিত করে পূজা-অর্চনা চলছে, তার পাশে নবগ্রহ যজ্ঞ সহ ঘৃতাহুতি ও বেদ পাঠ চলছে, অগণিত ভক্তবৃন্দ আবালবৃদ্ধ বণিতার সমাগমে এবং তাদের ঘন ঘন উলুর ধ্বনি ও হরিধ্বনিতে বঙ্কট বাবার প্রাঙ্গন মুখরিত হয়েছে। পরদিন সন্ধ্যায় শ্রী ক্ষুদিরাম সাহা আলোচনা কেন্দ্রে তার পূর্ব নিশির স্বপ্ন বৃত্তান্ত জানালে, একবাক্যে সকলেই বিশ্বাস করলো।
তারপর আমরা পাঁচজন ব্রতী হয়ে ১৩৬৫ সালের ১৩ ই বৈশাখ ২ য় সপ্তাহে ( ইং এপ্রিল মাসের ২৭-৪-৫৯) সংকল্প গ্রহণ করলাম আজ থেকে ৭ই পৌষ পর্যন্ত ক্ষৌরকর্ম করবো না।
প্রতি রবিবার সারাদিন মৌন থেকে, দিনান্তে সন্ধ্যা বন্দনা সাঙ্গ করে, একপক্ষ আতপান্ন গ্রহণ করবো, ব্রহ্মচর্য্য পালন ও প্রতি রবিবার উৎসবের জন্য ভিক্ষা করবো এবং ৬৪ প্রহর ব্যাপী, শ্রী শ্রী হরিনাম মহাযজ্ঞ ও তৎসহ ১০১ মন (একশত এক মন) আতপান্নের ভোগ লাগাবো।বিরাট মহাযজ্ঞ করতে প্রচুর টাকার প্রয়োজন। অনেকেই টাকা পয়সার প্রসঙ্গ তুললে আমরা বাবাকে স্মরণ করে এবং তার প্রতি বিশ্বাস রেখে বললাম, তা বাবা জানেন! তারপর আমরা কাজে ঝাঁপিয়ে পরলাম। পরে একটি সাধারণ সভা আহ্বান করা হলো। অন্নকূট এর প্রস্তাব তুলতেই অনেকেই অমত প্রকাশ করে, আমাদেরকে বিদ্রুপ্ করলো। অস্বাভাবিক নয়! রিক্ত হস্তে বিরাট যজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়া নেহাৎই, আহাম্মকি! আবার অনেকে বলল তোমরা খুব ভক্ত হয়েছে ব্রত গ্রহণ করেছে কিন্তু আমাদের কোন মত নেওনি! এবার বুঝ কিভাবে যোগ্য সঙ্গ করবে? তবুও আমাদের মনবল দিনের পর দিন বাবার কৃপায় ক্রমশঃ না কমে ক্রমশঃ বাড়তে থাকলো, মনের সৎ সাহস এবং উদ্যম অটল থাকায় বিরাট উৎসব এর কাজ এগিয়ে যেতে লাগলো। উৎসবের মাত্র দু মাস বাকি থাকতে বিরোধীদের খারাপ ভাব নিয়ে টনক্ পড়লো। তারা ভাবলো আমাদেরই দুর্নাম হবে, আমাদের মান খাওয়া যাবে, উপরন্তু বাবা কে অবমাননা করা হবে, তাই যুক্ত হওয়া সঙ্গত। পুনর্ব্বার সভা আহ্বান হলো শ্রী নগেন্দ্রনাথ সাহার আঙ্গিনাতে। উক্ত সভাতে আবার আমাদের বে-খেয়ালি বলে তিরস্কার দিবে, গ্রামের বয়ঃজ্যেষ্ঠ শ্রী ৺যামিনীকান্ত রুখে দাঁড়িয়ে বলতে আরম্ভ করল তারা ৫ জন না হয় ভুল বশতঃ আমাদের মত না জেনেই নেমে পড়েছে তখন কি আমাদের তাদেরকে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করে উক্ত কাজে যোগদান করা কর্তব্য নয় কি? অতঃপর পরিচালক শ্রী ৺হরেরাম সাহা নিজে অন্তরে বিবেচনা করতঃ অনুভূতি ব্যক্ত করলে, তার কথায় প্রতিবাদ না করে সকলে যুক্ত হলো। তারপর অন্য পুরুষ সম্বন্ধে জানার প্রয়োজন ও আবশ্যক উপকরণাদি তত্ত্ব সংগ্রহের প্রসঙ্গ উঠলে, একজন বলল মালদহ নিবাসী শ্রীযুক্ত বাবু৺আশুতোষ চৌধুরীর এ সম্বন্ধে বিশেষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই পরদিন শ্রী ক্ষুদিরাম সাহা ও শ্রী ৺সুরেশ চন্দ্র চৌধুরী "বাবুর" নিকট পরামর্শ নিতে যাত্রা করলেন। উভয়ই মালদহ উপস্থিত হয়ে অন্নকূট যজ্ঞের প্রসঙ্গ তুলতেই, তিনি আঁতকে উঠে বললেন, ওরে বাবা! এত বিরাট যজ্ঞ।
এই যজ্ঞের আমি পরামর্শ দিতে পারবো না, আপনাদের সাহস থাকলে করতে পারেন। উত্তর পেয়ে অগত্যা মন মরা হয়ে ফিরে এসে পুনশ্চ একটি সাধারণ সভার আহবান করা হলো, উক্ত সভাতে পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের স্বনামধন্য ব্যক্তিরা উপস্থিত হয়েছিলেন, তাদের নাম নিম্নে দেওয়া হলো।
শ্রী ৺নরেশ প্রসাদ যাদব, যুগলতলা (বাবার কৃপাধন্য পরিবারের বংশধর), শ্রী ৺গোপেশ্বর মন্ডল, রাজনগর। শ্রী ৺সুরেশ চন্দ্র চৌধুরী, আলিনগর। শ্রী নারায়ন চন্দ্র সিংহ, নুরনগর। শ্রী ৺চন্ডী পদ চক্রবর্তী, কালিকাপুর। শ্রী ৺সতীশ চন্দ্র ঘোষ রায়পুর। শ্রী ফকির চন্দ্র দাস, ছোট মোহেদিপুর। শ্রী ৺ধ্রুব নাথ সাহা, আলিপুর। শ্রী ৺দ্বিগেন্দ্র নাথ গুপ্ত, আলিপুর। শ্রী ৺প্রফুল্ল কুমার দাস (সেরিকালচার ডেমোনেস্ট্রেটর), তাছাড়া বিভিন্ন গ্রাম হতে ভক্তবৃন্দরা উপস্থিত ছিল। আমন্ত্রিত ব্যক্তিগণ সকলেই সমবেত হলে, শ্রী ৺হরেরাম সাহার সভাপতিত্বে সভার কার্য্য আরম্ভ হলো। বহিরাগত অনেক ভক্তই বলল, আমরা বাহিরের লোক যারা এসেছি, সহানুভূতি বই আর কিছু দিতে পারব না। প্রস্তুতি ও ঝুঁকি নিতে হবে আপনাদেরকেই, অনেক অনুরাগী ভক্ত আশ্বাস দিয়ে বলল, আপনারা যতদূর পারেন এগিয়ে যান, আমরা আপনাদের সহযোগিতা করব। এই কথা শ্রবণ করে শ্রী ৺নরেশ চন্দ্র যাদব, সুরেশবাবু ও গোপেশ্বর বাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে উক্তি করলো যদি এই মহাযজ্ঞে ক্ষতি হয় তবে তাকে বহন করবে? অবিলম্বে কড়জোরড় শ্রী ক্ষুদিরাম সাহা উত্তর দিলেন, আমিই ক্ষতি বহন করবো। যদি এই ক্ষতির জন্য আমাকে বিষয় সম্পত্তি বিক্রি করতে হয় তবুও করবো! এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে সবার লোকেরা বাবার জয়ধ্বনি করতঃ পূর্ণ সহযোগিতা করতে সম্মত হলে, যে যেমন কর্মে সক্ষম তাকে উপযুক্ত কর্ম ভার অর্পণ করা হল। যেমন কীর্তন, গায়ক ও যজ্ঞের উপকরণ সংগ্রহ। সকলেই আপন আপন কর্মভার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। শ্রী ৺হরেরাম সাহা উক্ত যজ্ঞে সভাপতি পদে এবং শ্রী ক্ষুদিরাম সাহা-সম্পাদক পদে নিযুক্ত ছিলেন। সর্ব প্রথমে শ্রী ৺ব্রজেন্দ্রনাথ পাঠক কীর্তনীয়াকে (নবদ্বীপ ধাম) আমন্ত্রণ ও বায়না করা হলো। তার নির্দেশ অনুযায়ী প্রবীণ ও প্রধান কীর্তনীয়া শ্রী ৺যামিনী কান্ত মুখোপাধ্যায়কে (মুর্শিদাবাদ) আমন্ত্রণ করা হলো এবং মুখার্জির উপরে কীর্তন পরিচালনার ভার অর্পণ করে আমরা নিশ্চিন্ত হলাম। নিম্নে অন্নকূট-এর সংঘটিত একটি বাস্তব কাহিনী লিপিবদ্ধ করা হলো।
নগেন্দ্র নাথ সাহা, রবি কুমার সাহা, গণেশ চন্দ্র সাহা ও জগন্নাথ পাল চারজনে রানীগঞ্জ নিবাসী বিখ্যাত শ্রী মধুবাবুর বাড়ি অভিমুখে রওনা হলো। উক্ত বাবুর বাড়ি পৌঁছে জগন্নাথ পাল শীত নিবারণ বস্ত্র বহন করে ক্লান্ত হয়ে ছিল, তাই-তার বাহির বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়লো। তারপর বাবুর খোঁজ করলে, একটি দাসি বের হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি জন্য বাবুর নিকটে এসেছেন? উত্তরে- আমরা অন্নকূট যজ্ঞের জন্য সাহায্য নিতে এসেছি।দাসী শুনে দুঃখিত মনে আধ আধ স্বরে বলল, দেখুন আপনারা যে উচ্চ আশা নিয়ে বড়লোকের নিকটে এসেছেন, এ আশা আপনাদের বৃথা। কেননা; কে বড়লোক শুধু নামের কিন্তু তার অন্তর বড় নয়! অতঃপর নগেন্দ্র নাথ সাহা ও গনেশ সাহা পাশের একটি গরীব বৃদ্ধ গোয়ালিনীর ঘরে উপস্থিত হতেই, বৃদ্ধা মাতা যথেষ্ট আতিথ্য আপ্যায়ন করে দুধ-চিড়া সেবা দিয়ে, অন্ন রন্ধনের জন্য অনুরোধ জানালে, দুজন অসম্মতি প্রকাশ করে বলল, মা আমাদের আরো দুজন সঙ্গী অভুক্ত অবস্থায় মধু বাবুর বাড়িতে রয়েছে, আমরা আপনার সেবায় অতিশয় প্রীত হয়েছি। ক্ষুধার্ত পরিষেবা দিয়ে আপনি পুণ্যবতী জননী হলেন, আমরা তাতেই অত্যন্ত ধন্য হলাম। এই কথা শ্রবণেই বৃদ্ধা মাতা নম্রভাবে কাতর স্বরে বললো, বাবা আমি গরীব মানুষ আমার সাধ্য অনুযায়ী মাত্র এক টাকা বাবার যজ্ঞের জন্য দিলাম, কৃপা করে গ্রহণ করো। এদিকে মধু বাবুর বাড়িতে দুজন এদিক-সেদিক ঘুরে দেখল যে শ্রী শ্রী রামচন্দ্রের পূজা মন্ডবে শ্রীবিগ্রহ সম্মুখে বিভিন্ন উপাচার দিয়ে পূজারী ধ্যানাবিষ্ট রয়েছে, ক্ষণিক পড়ে ফু জানতে ষষ্ঠাঙ্গ প্রণিপাত করলে, ওই দৃশ্য দেখে রবি সাহা প্রসাদ যাঁচিঞা চাইলো। কিন্তু পূজারী তার খেয়াল বসতঃ এদিক সেদিক ব্যস্ততায় কোন উত্তর দিলনা। কিছুক্ষণ পর পূজারী সেবা করতে আহ্বান জানালে দুজন উত্তর দিলো একটু অপেক্ষা করুন আমাদের আরো দুজন বাইরে আছে, তাদের ডেকে নিয়ে আসি। তবে সন্ধানে এক পথে দুজন বের হলো আর অন্য পথের দুজন প্রবেশ করলো। হেনমতে কয়েকবার ঘোরা ফেরায় পূজারী বিব্রত হয়ে কটুক্তি করলে, চারজন মর্মাহত হলো। কি আর করে যতক্ষণ গ্রহ দোষ ছিল, দারুণ বিধি তা উপভোগ করায়ে তাদেরকে বিভ্রান্ত করলো। এটাও নিয়তির চক্রান্ত।